Thursday, June 6, 2013

Nilkantha Pakhir Khonje - Atin Bandopadhyay

অতীন বন্দোপাধ্যায়ের " নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে " পড়লাম। আগে কখনো অতীন বন্দোপাধ্যায়ের কোনো লেখা পড়ি নি আমি। কেন জানি না, এই বইটা পড়ার ইচ্ছা কিছুদিন ধরেই তীব্র হচ্ছিল। কিনে ফেললাম।  পড়তে শুরু করলাম। আর ভেসে গেলাম। ভেসে গেলাম এক অদ্ভুত সাবলীল স্রোতে। লেখার এমন সাবলীল গতি সত্যি অনকেদিন পরে পড়লাম। গ্রাম-বাংলার জীবন নিয়ে লেখা তো অনেক পড়েছি , কিন্তু গ্রাম-বাংলার জীবনের সাথে এমনভাবে অন্তরীণ হয়ে যাই নি কখনো। "আম-আঁটির  ভেঁপু"র পরে গ্রাম-বাংলার এমন প্রাঞ্জল অথচ অবিকৃত ছবি বোধহয় কেউ আঁকতে পারেন নি। চরিত্র, চরিত্রের মুখে ভাষা, তাদের জীবনধারা -এসব ই যেন বড্ড চেনা, বড্ড কাছের। অপরিচিত চরিত্রগুলোর পিছনে তাই যেন বেশ কয়েকটা পরিচিত মুখ ভেসে উঠছিল। মনে হচ্ছিল ওই ফতিমাকে আমি চিনি। মনে হচ্ছিল ওই স্থলপদ্ম গাছটা আমার ছোটবেলার স্থলপদ্ম গাছ, যার ফুলগুলোকে আমার বৃহদাকার গোলাপ ফুল বলে মনে হত। আর একটা স্থলপদ্ম পাওয়ার জন্য আমি পাড়ায় - বেপাড়ায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। 

লেখকের সাবলীলতা যেমন আমাকে মুগ্ধ করেছিল, তেমনই বিস্মিত করেছিল তাঁর পরিচ্বন্ন পরিশীলতা। সমগ্র উপন্যাসখানি জুড়ে এক প্রছন্ন চরিত্র " পলিন"। সে থেকেও নেই , আবার না থেকেও আছে। তার থাকা - না- থাকার সুত্রে বাঁধা পরে গেছে একের পর এক চরিত্র। তাদের জীবনের উত্থান -পতন সবই যেন পলিন নির্ধারিত। "পলিন -মনিন্দ্রনাথ"এর প্রেমগাথা কোথাও অনাবশ্যকভাবে অতিরঞ্জিত হয়ে ওঠে নি। অথচ তাঁরা চিরন্তন প্রেমের আদর্শ স্বরূপ। তবু তাঁদের কখনো অতিনাটকীয় হতে দেখা যায় নি। যে কোনো লেখকের পক্ষে এই লোভটুকু সম্বরণ করাও কম কৃতিত্বের কথা নয়। অতীন বন্দোপাধ্যায় এর এই সংযমই 'পলিন-মনিন্দ্রনাথ' কে কখনো সস্তা চরিত্র হয়ে যেতে দেয় নি। তাই আমরা পাঠকরা পেয়েছি মনের গভীরে ছুঁয়ে যাওয়া এক অন্য রকম প্রেমিক পুরুষকে। 

পলিনের কথা বললে 'বড় বউ' কে বাদ দেওয়া যায় না। সাধারণ গ্রামবাংলায় একেবারে গ্রাম্য এক বধু কি করে সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে রাখল এমন এক গভীর মননশীলতা? কখনো তাঁকে মনিন্দ্রনাথের মত এক উচ্চশিক্ষিত , মহাজ্ঞানী স্বামীর অযোগ্য স্ত্রী বলে মনে হয় নি। বরং স্বামীর মৌনতা আর তাঁর মৌন-মুখরতা - এই দুই এ মিলে এক স্বতন্ত্র দাম্পত্য বন্ধন তৈরী করেছে। সে বন্ধন আর দশটা সাধারণ স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক থেকে অনেক বেশি সূদৃঢ়। তাই 'পলিন' প্রেমে পাগল জ্যঠা মশাই শুধু দুটি অপেক্ষারত  চোখ দেখে নিমেষে ফিরে আসতে পারেন সাধারণের পরিচিত ' বাস্তব ' দুনিয়ায়। আর আপাদমস্তক গ্রাম্য সংস্কারে আচ্ছন্ন জ্যাঠাইমা পারেন স্বামীর তালে তাল মিলিয়ে তরমুজ ক্ষেতে আদম আর ইভের মত ঘুরে বেড়াতে। নাই বা বুঝলেন তিনি কিটস এর কবিতা। কিন্তু কিটস পরা তাঁর স্বামীর মনটাকে বোঝেন তিনি। এ প্রেম অদ্ভুত। এ সখ্য সত্যি ই অন্যরকম। 

সোনাকে নিয়ে বেশি কিছু লিখব না। কারণ বইখানি পড়ে আমার মনে হয়েছে , সোনা নয়, সোনার চোখ দিয়ে দেখা চরিত্রগুলো তুলে ধরাই  ছিল লেখকের উদ্দেশ্য। তাই প্রতিটা চরিত্রই মনে শ্রদ্ধা জাগায়। প্রতিটি চরিত্রই নিজের চরিত্রকে আর একবার বিচার করতে শেখায়।

আর একটি চরিত্র বুড়া কর্তার চরিত্র। গোঁড়া হিন্দু ধর্মের রক্ষনশীল পিতা , পুত্রকে ধর্মচ্যুত হতে দেবেন না। তাই তিনি যেকোনো কৌশল অবলম্বন করতে পারেন নিজের ধর্মপালনের জন্য। এই চিরাচরিত গল্প তো সেকাল থেকে একাল অবধি বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেরই পটভূমি।  কিন্তু সেই একঘেয়ে ঘটনাকে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করেও লেখক এই বৃদ্ধ পিতার চরিত্রে এনেছেন অনন্য এক ছোঁয়া। আর কোনো লেখক বোধ হয় ধর্মের সঙ্গে সংস্কারের সঙ্গে পিতৃত্বের নীরব লড়াইকে এমন  সুক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি তাঁর লেখনীতে। সাধারণত এমন ক্ষেত্রে নায়কের যন্ত্রনাই আমাদের সমব্যথী করে তোলে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে এখানে এক ব্যথাতুর পিতা সমানভাবে ভাগ বসিয়েছে আমাদের সেই সহানুভুতিতে। কোন ও যুক্তি-অযুক্তিকে গ্রাহ্য করে নি পাঠক মনের এই সহমর্মিতা।  অথচ বৃদ্ধ  মহেন্দ্রনাথের মধ্যে কোথাও এতটুকু ' অতি ' নেই।

সব শেষে ' পাগল ঠাকুর। ' আমার অতি প্রিয় একটি চরিত্র। সোনার চোখ দিয়ে না দেখলে লেখক বোধ হয় সত্যি পারতেন না এমন এক দুর্গম চরিত্র কে এমন এক সহজ ভঙ্গিমায় প্রকাশ করতে। আর কোনো গল্প , কোনো উপন্যাস মনিন্দ্রনাথের মত এক চরিত্রকে পেয়েছে কিনে জানি না। এ চরিত্র স্বমহিমায় ভাস্বর। যেন আর কারো প্রয়োজন নেই তাঁর জগতে। তাঁর সুদৃঢ় স্কন্ধে তিনি একাই ধরে রাখতে পারেন সমগ্র এক উপন্যাসের টান। সোনার সঙ্গে তাঁর যে অব্যক্ত সম্পর্ক তাই ভাষা হয়ে ফুটে রয়েছে সমগ্র উপন্যাস জুড়ে।

 আমার অতি কাছের কোনো মানুষের সঙ্গে বড় মিল পেয়েছিলাম আমি মনিন্দ্রনাথের চরিত্রের সাথে। তাই জানি না চরিত্রটির প্রতি আমার এই অনুরাগ পক্ষপাতদুষ্ট  কিনা। পক্ষপাতটুকু বাদ দিলেও কিন্তু একথা এক বাক্যে স্বীকার্য যে মনিন্দ্রনাথ এক অনন্য সাধারণ চরিত্র। তাঁর সাথে আর কারো তুলনা চলে না। মনিন্দ্রনাথকে জেনেও কখনো বলা যায় না, " এ চরিত্র অমুক লেখকের অমুক চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।" তিনি নিজেই একটি একক। 

কিন্তু তাঁর শেষটুকু নিয়ে লেখকের প্রতি আমার ভারী অভিযোগ। এমন এক রাজকীয় চরিত্রের এ কেমন ধারা অন্ত ? কখনো যদি লেখকের ঠিকানা জোগাড় করতে পারি তো এ লেখা আমি তাঁকে নিশ্চই  পাঠাব। একি সত্যি ঘটনা ? জ্যেঠামশাই এর মৃত্যু কি সত্যি-ই এমন মর্মান্তিক ? যদি তা না হয় তবে কি প্রয়োজন ছিল এমন এক নিষ্ঠুর পরিনতি আঁকার ? ফেলু শেখ এর মত চরিত্রও নিজের একটা সমাধি পায় , মৃত্যুর পরে চোখের জল ফেলার মত একজন প্রেমিকাকে পায়। আর ' পাগল ঠাকুরের ' মত আপাদমস্তক সৎ এক চরিত্রের কিনা এমন এক গুমনাম মৃত্যু ! এই পরিণতির সঙ্গে কিছুতেই সহমত হতে পারছে না। গল্পের কোনো স্বার্থও তো পুরণ  করছে না তাঁর এই  হঠাৎ মৃত্যু !  বড় বউকে  যদি আমরণ প্রতীক্ষায় রাখাই গল্পকারের উদ্দেশ্য হত, তাহলে ডিঙ্গিতে চড়ে পাগল জ্যেঠামশাই হারিয়ে যেতে পারতেন। আমরা , পাঠক রাও তাহলে জেঠাইমার সাথে তাঁর ফেরার অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু আমাদের এই অপেক্ষাটুকুও কেড়ে নিয়ে লেখক কি পেলেন ? জ্যেঠামশাই -ই বা কি পেলেন ! হয়ত তিনি অবশেষে পলিনের সাথে বিলীন হয়ে যেতে পারলেন। কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র মন তাঁকে কাছ ছাড়া করতে  চায় না। বার বার মনে হয় বিচার হলো না , সঠিক বিচার হলো না।