মুহূর্তযাপন
প্রতিদিন আসে মুহূর্তরা, প্রতিদিন ফিরে যায়। অসংখ্য মুহূর্ত দিয়ে গাঁথা মালারা মূর্ত হয়ে ওঠে ঘটমান বর্তমানে। সেই ঘটনাগুলোকেই আমরা চিরস্থায়ি ভাবি ; ভাবি এরাই বোধ হয় মনকে জয় নিল। চিরদিনের মত জায়গা করে নিল মনের দরজায়। কিন্তু একদিন যাকে চিরস্মরণীয় মনে হয়, জীবনের দোলাচলে পরের দিনই হয়তো দেখা যায় , বিস্মৃতির অতলে তলাতে তলাতে তারা একেবারেই হারিয়ে গেছে জীবন পথের বাঁকে।
আবার অন্য কোনো মুহূর্তরা - যারা হয়ত নামহীন , যারা হয়ত শুধুই হঠাৎ কিছু পাওয়া , তারা বার বার ভেসে ওঠে মনের জলছবিতে , অকারণে , বিনা আহ্বানে। একদিন তারাও অতীত হয়ে যায়। আর অতীত বলে তাদের ছাপও কিন্তু হালকা হয় খানিক। কিন্তু তাতেই যেন আরও মোলায়েম হয়ে ওঠে তারা। আরও বেশি মাধুর্য্যমন্ডিত হয়ে তারা উঁকি দিতে থাকে মনের খোলা জানলায়। সে জানলা চাইলেই বন্ধ করা যায় না , আপনা হতেই তার কপাটগুলো খোলা বন্ধ হতে থাকে আনমনা মুহুর্তে , আরও আনমনা হয়ে পড়ে মন।
এত ভুমিকা শুধু সেই মুহূর্তগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যারা আমার জীবনকে পাওয়ায় পাওয়ায় ভরিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ এসেছে না বলে। কিন্ত না বলে যেতে দিই নি আমি তাদের। দুচোখ ভরে দেখেছি আমি তাদের , মন ভরে শুনেছি তাদের কথা। আমার প্রতিটা ইন্দ্রিযকনা শুষে নিয়েছে তাদের ; আপন করে নিয়েছে। তারা হয়ে গেছে আমার , একান্ত আমার মুহূর্ত। আমার বেঁচে থাকার গান।
সেদিনের ভোরও তেমনি এক ভোর , যা বহুদিন পর আবার চোখে ছড়ালো মুগ্ধতার আবেশ। সেদিনই প্রথম বুঝলাম , প্রতিদিনই ভোরেরা আসে , প্রতিদিন তারা ফিরে যায় আমায় ডেকে ডেকে। আমার কানে সে ডাক পৌঁছয় না। আমার সময় হেলায় বয়ে যায় অচেতনে। আমি ঘুমিয়ে থাকি বা জেগে থাকি , আমার মন থাকে সুপ্ত। সে জাগতে চায় না , যেতে চায় না উত্তরণের পথে।
কিন্তু সেদিন যেন বাঁধ ভাঙ্গার দিন ছিল। জেগেই ছিলাম আরও অনেক দিনের মত । জানলার পর্দা সরানো ছিল রোজদিনের মত। হঠাৎ যেন কেউ টেনে নিল আমায়। টেনে নিল একরাশ উপছে পড়া জোছনা। আমার সুপ্ত মন যেন বিস্ময়ে জেগে উঠলো। চোখের উপর সমস্ত পর্দার পরত সরিয়ে সামনে তখন হলদেটে সাদা রঙের মস্ত এক গোল চাঁদ। বলে দিতে হলো না , আজ পূর্নিমা। ভোর জানি রাতের বিদায় নেওয়ার সময়। রাত আর ভোরের এই মিলনক্ষণে চাঁদ প্রকৃতিকে তুলে দেয় সূর্যের হাতে। এ তো তার বিদায়ক্ষণ। তাই ভাবতাম যাওয়ার কালে বোধ হয় বিষন্ন হয় সে। তার আভায় ঝরে পড়ে বিদায়ের বিষন্ন সুর। কিন্তু কোথায় কি ! আমার অজ্ঞতায় যেন রানীর মত হাসছে চাঁদ। বলছে , আমি রুপমতী , আমি স্নিগ্ধতা , আমি মন ভোলানো মুগ্ধতা। সত্যই তাই। তাই সে সতত ভাস্বর স্বমহিমায়।
আমি প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ , পাগলপারা এক শিশু , শুধু দেখতে লাগলাম দুচোখ ভরে। আলোয় আলোয় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। বড় ,আলতো , বড় নরম সে আলো। আলতো আলোর আলতো ছোয়ায় ঘুমিয়ে আছে শহর। গাছেরাও তখন ঘুমিয়ে। সূর্য্য এসে ডাকে নি এখনো তাদের। তাই তারা বুঝতে পারছে না কি অদ্ভুত , স্নিগ্ধ আলো গায়ে মেখে ঘুমিয়ে আছে তারা , নিশ্চুপ। যেন সামান্য নড়লেও ছন্দপতন হবে এই অলৌকিক ইন্দ্রজালের। আমি চোখ বুজতে পারছি না। আমি ভরে যাচ্ছি পূর্ণতায় - আহা , কি দেখলাম। পাশে আমার ছোট্ট মেয়ে , গভীর ঘুমে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। দেখলাম , এক ফালি জোত্স্না এসে পড়ে রয়েছে ওর ঘুমন্ত মুখের উপর। চাঁদ ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর ঠোঁট , নাক , ছোট্ট চিবুক। যেন প্রকৃতি স্বয়ং ওর কপাল চুমে পরিয়ে দিচ্ছে আশীর্বাদের টীকা। চোখের পাতা ভরিয়ে দিচ্ছে জোত্স্না মাখা রূপকথায়। পবিত্রতম মুখে পবিত্রতম আলো। আমি শুধু দেখে চলেছি দু চোখ ভরে। মনে আছে , সেদিনই প্রথম আশির্বাদ করেছিলাম ওকে। আগে সকলের জন্য শুধু প্রার্থনা করেছি , আশির্বাদ করি নি কাউকে। সেদিন যেন আপনা হতে বেরিয়ে এলো , বললাম , " শুধু দেখতে শেখো " ; মনে হয়েছিল , শুধু ছুঁয়ে যদি কাউকে কিছু বিলিয়ে দেওয়া যেত , তাহলে ওকে ছুঁয়ে আমার সমস্ত প্রকৃতিপ্রেম উজার করে দিতাম ওকে। আমার সবটুকু দিয়ে দিতাম , শুধু দেখার এই চোখ দুটো দেওয়ার জন্য। শুধু দেখতে জানলেও জীবন সার্থক হয়ে যায় , মনে হয় মাঝে মাঝে।
পশ্চিমে পূর্নিমার এই হাসি মুখ দেখে মনে হযেছিল , রাত্রি বোধ হয় আজ বেশি সময় পেয়েছে। তাই মাতিয়ে চলেছে শেষ রাতের আসর। বারান্দায় গেলাম , বুঝলাম , প্রকৃতি তার নিয়ম ভোলে না। পূব আকাশে যথা সময় এসে হাজির হয়েছে ঘুম ঘুম মাখা রবির কিরণ। দূর পারটা লালচে আভায় ভরিয়ে , কাছের আকাশটায় যেন দিনের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে আগে ভাগেই। ভাবলাম এ কি দিলেন ঈশ্বর আমায় আজ !আমার দুচোখ যে কম পড়ে যাচ্ছে এই বিশালত্বের কাছে। আমি যেন অদ্ভুত পবিত্র এক সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে। আজ সত্যিই প্রত্যক্ষ করলাম , রাত্রি এসে মিশল দিনের পারাবারে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন , " তোমায় আমায় দেখা হলো সেই মোহনার ধারে।" আজ সেই 'তোমা'কে পেলাম আমি নিজের মাঝে। স্বর্গীয় কোনো লগ্নে ঈশ্বরবোধের আবির্ভাব , সৌন্দর্যবোধের উপলব্ধি - সেই কি 'তুমি' নও ? আমিত্ব মুছে যায় যখন বিশালত্বের সামনে , সেই কি তোমার দেখা দেওয়া নয় ?
ঘরে এলাম। সেদিন বোধ হয় পূর্ণতায় কোনো ফাঁক রাখতে চাও নি তুমি, ঈশ্বর। তাই দেখলাম আমার প্রাপ্তির ডালা সযত্নে কেউ সাজিয়ে রেখেছে ললিতে। আমি শুনলাম , আমি দেখলাম। আমি দেখলাম, আমি শুনলাম। সুরের মারপ্যঁচ কিছু মাথায় এলো না , শুধু কানে এলো মূর্ছনা। সঙ্গীতের আবহে প্রকৃতিকে দেখছি , নাকি সঙ্গীতের রূপ হয়ে ফুটে উঠছে প্রকৃতি - বুঝতে পারলাম না। সব যেন মিলে মিশে একাকার। শুধু বুঝলাম দুজনেই বলছে , ভোর হয়েছে , এসেছে সেই শুভক্ষণ , যেখানে রাত মিলে যায় দিনের আভায় , সুর মিশে যায় মনের রঙে। রাগের রূপ তো বর্ণনা করতে পারি না , কিন্তু ভোরের ওই ফুটতে থাকা আলোই কি সেই রাগের প্রকৃত রূপ নয় ? এর থেকে রূপসী আর কি তাকে দেখেছে কেউ ?
দিনের আলো ফুটে গেল। শরীর , মন কেউ বলল না , " শুয়ে থাক।" রেওয়াজে বসলাম -" আদ ভৈরব রাগ রূপ ধরে।" সত্যিই ভৈরব তার আদি রূপটুকু দেখিয়ে গেল আজ আমায়।
আজ জোত্স্নায় মাখামাখি ভোর
দুচোখ ভরে ভরিয়ে রাখা স্বপ্ন মদিল ঘোর -
শান্ত নিঝুম সঙ্গীতে আজ তোমার অসীম বাণী
প্রণমি তোমায় , হে দীননাথ ;
আপনাকে আজ আপনা হতে বাহির করলে আনি।
তোমার জীবনের প্রতি মুহুর্ত যেন এই ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তোমায় আলোকিত করে
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeletebhasha neii byakto korar moto shudhu cheye achhi...odhadharon lekha...
ReplyDeleteSagar dekhe Bankim er Naba Kumar bolechhilo , " Aha ! Ki dekhilam ! Janmo Janmantareo vulibo na ". Durbar "Muhurtojapon " pore amaro mone hochhe , " Aha ! ki porilam ". lekhati lekhikar chira pabitra romantic moner swochho aayna . Bahirjogot e taar sansarik bystota aar antar jagot vore ache ek aporup suravito madhurje . Je madhurjo biswa prokritir anobadyo rup sushoma theke udbodhito hoyechhe . Lekhikar rupamoy , rasomoy antardristir joy hok . Joy hok manusher anabil soundarjo chetanar . Durba durbar hok .
ReplyDeleteRanen ( Dhara ) Kaku
esechilo nishwabdo prem
ReplyDeleteraat aar vorer milane
tumi chuyechile se charan
purna anaami sei khan e
muhurto valobasa hoye
ghire thak tomar hriday
sekhane royeche jara mishe
hok tara chiro akhkhoy
......mangal hok....prarthona..
September 29, 2014 at 7:45pm · Unlike · 2
beautiful blog.. Keep updated...
ReplyDeleteSeptember 29, 2014 at 9:07pm · Unlike · 1
beautiful blog.. Keep updated...
ReplyDeleteAtasi, blog e comment like korar scope nei re . Tai ekhanei bolchhi , thanx. Eto ta lekha ei pujor marshume dhoirjo dhore porar jonyo.. valolaga tuku shudhu share korte cheyechhilam. Atashi Chatterjee
ReplyDeleteOctober 3, 2014 at 1:44am · Edited · Like · 1
..
Thanx subir , will try my best
Ekjoner mon theke lakha jodi arekjoner mon chhuye jay tobei sei lekhar mahatyo roy..janina keno ami tor lekhata feel korte parchilam.thanx 2 u for such a nice writing.
ReplyDeleteOctober 4, 2014 at 1:58pm · Unlike · 3
mone hole kono sundor sapno dekhlam jar resh r ghhor akhono bartoman...r ichchheo nei ta theke beronor..atodin e theke bonchito thktehowar akkheptao jano mlan hoe galo..tomar karone ami abar samriddho holam..
ReplyDeleteOctober 10, 2014 at 11:19am · Unlike · 2
Mitu , ami tomar modhye amar nijeke khuje pai .. amar ager nijeke .. tai khub cheyechhilam tomar sathe ei valo laga , ei upolobdhi tuku share korte .. jantam .. tumi anuvab korbe .. tai valo lagchhe tomay porate pere .
DeleteDidi, atyanto govir ebong porinoto lekhoni..ami porte porte raat theke vor hobar akta sposhto chobi dekhte pelam moner majhe..apnar purnota praptir swaad hoyto kichuta amio anubhab korlam ei lekha pore..songe apurbo chobi..kya baat..valo thakben..
ReplyDeleteOctober 10, 2014 at 11:33pm · Unlike · 1
ami khubi kom likhi... tomar bahu lekha porechhi..valo lage porte.. besh kichhu lekha moneo theke gechhe . Etotai valo..likho..r o .
DeleteChhobir krititwe to amar eto tuku vaag nei.. chhobi guloi lekha ta sundaratoro korechhe .. purno korechhe. Valo theko.
amar khudro proyas guli apnar mone sthan peyeche sune anondo holo.. likhbo obossoi..sudhu lekhar pothe apnar Ashirbad kamyo..
DeleteShuvechha roilo.
DeleteProtiti bakyer jeno ek alada soundarjata
ReplyDelete