আমার কালীপুজো 
এক স্মৃতিচারণা 
  
 
কালীপুজো  মানেই বাবা। একটা ঠান্ডা নামা গন্ধ।  বেলা ছোট হয়ে আসা বিকেলে ট্রেনের আওয়াজ।  একটা ছোট্ট স্টেশনে অল্প থামা প্যাসেন্জার ট্রেনের সরু দরজা দিয়ে তাড়াহুড়ো  করে লাফিয়ে নামা আর ট্রেনের শেষ কামরাটা মিলিয়ে যাওয়া অবধি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা। গুটি কয়েক দাঁড়ানো রিক্সা নিয়ে রিক্সা স্ট্যান্ড। পরিচিত বুড়ো কোনো মুখ।  রিক্সাওলা।  মদন , বুড়ো , বিশে। বাবা আর তাদের চোখের হাসিতেই বোঝা যায় - " নিজের দেশের লোক। " তারপর একটা একটা এক চালা , ভাঙ্গা চোরা অতি পুরনো মিষ্টির দোকান। ভন ভন করে মাছি উড়ছে সব কটা মিষ্টির থালার উপর। পৃথিবীর সব চেয়ে সুস্বাদু রসগোল্লা।
তারপর।  তারপর আহ।  আমার গ্রাম।  মসৃন রাস্তায় ধীর গতিতে আরাম করে চলা রিক্সার ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ।  দু পাশে দু চোখ ভাসানো হেমন্তের ধানক্ষেত।  আর ঘুরতে থাকা প্যাডেলে রিক্সাওয়ালার পা। মনে এক অসম্ভব আনন্দ নিয়ে সবার সাথে চলেছি ছোট আমি। ঝুরি নামা বুড়ো বটতলাটা পেরিয়ে গেল।  বলফিল্ড , কার্লভার্ট , কার্লভার্ট এর উপর উবু হয়ে বসে থাকা বুড়ো দুটো লোক।  যেন অনন্তকাল ধরে ওরা ওখানেই বসে আছে।  যেন প্রতিবারই আমার দিকে এমন ভাবেই তাকিয়ে থাকে ওরা আর নীরবে জিজ্ঞেস করে , " কারা যায় ? " ডান ধারে একটা চালা ঘর।  রাশি রাশি লম্বা পাটকাঠি শুকোয়।  প্রতিবার বাড়ির সামনে দুটো বাচ্চা খেলা করে আর তাদের রোগাটে বুড়ি ঠাকমা , পথের উপর বসে রাস্তা দেখে।  আর একটু এগোলে বাঁ দিকে একটা বড় উঠোনওয়ালা বাড়ি।  কুঁড়েঘর।  উঠোনে দুটো পেল্লাই ধানের গোলা আর পাশে বসে জাবর কাটতে থাকা দুটো গরু।  একটা সাদা , একটা কালো।  বাবা একবার নেমে গিয়ে ছবি তুলেছিল।  কোথায় সেই ছবিটা ? কে জানে !
বকুলতলার মোড় ঘুরতেই আমাদের পাড়া।  চেনা ঘর, চেনা দোকান , চেনা পোস্টাপিসের  লাল বারান্দা।  ডাইনে  বাঁ এ বড় বড় ঠাকুরদালান আর সেখানে কাঠামোয় মাটির প্রলেপে সেজে উঠতে থাকা কালীর মূর্তি।  রিক্সাটা  পোস্ট অফিস থেকে বাঁ দিকের ঢালে নামতেই ভিতরে ছটফটানি উত্তেজনা।  ডান দিকে ঘুরতেই ঠিক একই জায়গায় ভেঁপু হর্ন বাজায় রিক্সাটা।  বহু পুরনো লোক।  জানে ঠিক , দোতলার জানলায়  বহুক্ষণ ধরে উত্কীর্ণ হয়ে বসে আছে একজন , আমার ঠাম্মা।  সারা বছর বসে থাকে সে ওই একটা হর্নের অপেক্ষায় , মস্ত এক বাড়িতে , একা।
রিক্সাকে  বলতে হয় না।  ঠিক দরজার সামনেই দাঁড় করায় সে।  আহ আমার বাড়ি।   দরজায় ঠাম্মা।  তাই কালীপূজো মানেই অপেক্ষা।  ঠাম্মার অপেক্ষা আমাদের জন্য।  আমার অপেক্ষা গ্রামের জন্য , বড্ড প্রিয় বাড়িটার  জন্য , কালীপুজোর জন্য।  আমার অপেক্ষা আজও  থেকে গেছে।  কিন্তু আমার অপেক্ষায় আর কেউ নেই।  আজও অভ্যেসবশত প্রতিবার কালো জানলাটার দিকে তাকাই।  বন্ধ জানলা।  আজ কেউ গরাদ ধরে বসে থাকে না।
#
 
আমার অখ্যাত গ্রাম , বেলপুকুর।  ইতিহাসের দিক থেকে অতি প্রাচীন , নদিয়ার এক গ্রাম। কেউ চেনে না।  কেউ নাম ও জানে না।  জানি শুধু আমি।  ছোট্ট একটা নিজের মনে থাকা মেয়ে।  তার চেনা গন্ডির মধ্যে প্রতিদিন আবিস্কার করে সে বিস্মিত হওয়ার  নতুন নতুন উপাদান , ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নতুন কোনো গিরগিটি , হ্ঠাৎ লাফিয়ে ওঠা কোনো ছানা ব্যাং অথবা বন বাদরের মধ্যে অবহেলায় গজিয়ে ওঠা নতুন কোনো জংলি ফুল।  পাশেই শীতে শুকিয়ে যাওয়া অগভীর খাল।  জলের  কাছে যেতে হলে অনেকটা শুকনো খেত পেরোতে হয়।  আবাল্য শহরে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে আল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে অনায়াসে গিযে পৌছোত জলের ধারে।  দু হাতে জড়ো করত কচুরিপানার ফুল।  সারাদিন ছোট্ট  একটা মাটির ঘটে ভেজানো থাকত ফুলের সেই গোছা। আজ যদি পেতাম , রজনীগন্ধার বদলে কচুরিপানার ফুলেই ঘর সাজাতাম আমি।  অপূর্ব সে ফুল।  আমার সব চেয়ে প্রিয় ফুল , কচুরিপানা । 
 
 
বেলপুকুরে প্রতি ঘরে ঘরে কালীপুজো হয় , অতি প্রাচীন কাল থেকে।  শুনেছি এখানেই প্রথম কালীপুজোর পত্তন হয়। পঞ্চমুন্ডির আসনে।  সত্য মিথ্যা জানি না।  তবে মানি।  শুনে আসা প্রতিটা কথাকে বিশ্বাস করি।  ভালো লাগে বিশ্বাস করতে। 
 
সেই থেকেই পুরো গ্রাম শাক্ত।  বাংলার বোধ হয় এক মাত্র জায়গা , যেখানে দুর্গাপুজো নয় , কালীপুজোই মূল উৎসব।  ঘরে ঘরে কালীর আরাধনা।  বাড়িতেই ঠাকুর গড়া হত তখন ।  অনেক পরে বড় হয়ে জেনেছি , ওটা আমাদের নয় , লাগোয়া জ্ঞাতির বাড়ির পুজো।  আইন যাই বলুক , আমার শিশু মন তাকেই বাড়ির পুজো বলে জানত, আজও  জানে।  বাড়িতেই ঠাকুর গড়া হত তখন।  সুবোধ , আমাদের বাড়ির কুমোর , নিরীহ , রোগা , গোবেচারা ভাবের একটা লোক ,  সারাবছর আমার জন্য মাটির পুতুল বানিয়ে দিত।  কত পুরনো মানুষের নাম - মুখ মনে পরে যাচ্ছে আজ লিখতে বসে।  সেই সুবোধ সারাদিন ধরে  ঠাকুর বানিয়ে যেত এক মনে ।  আমি আর দাদা দুজনেই বার বার দেখতে যেতাম ছুটে ছুটে , কত দূর হলো ।  আর শুধু জিজ্ঞেস করতাম ,  " চোখ কখন আঁকবে ? আমাকে ডেকো  কিন্তু।  " বলা বাহুল্য সুবোধ কোনো দিনই ডাকে নি।  তবে   কোনো দিন আমাকে ফাঁকিও দিতে পারে নি। ।  চোখ আঁকার সময় ঠিক পৌছে যেতাম আমি  সামনে। কালো মুখে লাল টানা চোখ - একটানে এঁকে যেত ও। প্রতিবার এক রকম।  কোনো বার এত টুকুও অন্য রকম হয় নি।  আমি মা এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতাম , নিস্পলক , নির্বাক ।  আজ সুবোধ নেই।  এখনো একই রকম মাতৃমূর্তি হয়।  কালো মুখে টানা টানা লাল চোখ।  হাত বদলেছে , কিন্তু ঘরানা বদলায়  নি।  কোথাও এতটুকু অন্যরকম হয় নি।  
 
 
#
 
 
কালীপুজোর আগের দিন।  ঠাকুর  পাটে ওঠার দিন।  চোদ্দ শাক , চোদ্দ প্রদীপের দিন।  আমার কচি হাতে ঘন্টার পর ঘন্টা আলপনা এঁকে যাওয়ার দিন।  তখন কেনার প্রথা ছিল না।  আমি ই এদিক ওদিক ঘুরে চোদ্দ রকম শাক তুলে আনতাম।  আমি , দাদা , ঠাম্মা - তিন জনে মিলে সাত দিন আগে থেকে বানাতাম মাটির প্রদীপ।  অত বড় বাড়িতে চোদ্দটা  প্রদীপ খুজেই পাওয়া যেত না।  কিন্তু চোদ্দটাই জ্বালানো হত সেদিন।  পরের দিন সাজানো হত বেশি প্রদীপ দিয়ে।  আজ বাড়িতে বাড়িতে রকমারি চীনা আলো।  টিমটিমে প্রদীপ শিখাগুলো জিততে পারল না তাদের কাছে।  
 
 
বিকেল থেকে সাজতে শুরু করত ঠাকুর।  একটা একটা করে ডাকের সাজ উঠত আর একটু একটু করে মোহময়ী হয়ে উঠত সদানন্দময়ী কালী , মহাকালের মনমোহিনী।  আমি তখন ও আলপনা দিয়ে  যেতাম, যতটা পারা যায়। খালের ধার থেকে পর পর ঠাকুর পাটে তোলা হত মহাসমারোহে।  সেটাই রীতি।  সেই কস্মিনকাল থেকে কোনো রীতির বদল ঘটায় নি বেলপুকুর।  আজও ঘটায় না।  একই  রকম  নির্ঘন্ট মেনে , প্রথা মেনে ঠাকুর পাটে ওঠে ঘরে ঘরে।  একই রকম প্রথা মেনে বিসর্জনে যায় , একসাথে।  
 
#
 
কালীপুজোর দিন ভোর বেলা।  শিশির ভেজা ঠান্ডা।  ভোর চারটেয়  উঠতাম আলো ফোটার আগে।  আলো ফুটলেই গাছে আর কোনো ফুল পাওয়া যাবে না ।  আমি আর ফুলি , ছোট্ট  দুটো মেয়ে , কুয়াশা মাখা ভোরে ঠিক বেরিয়ে পড়তাম।  ফুল চুরি ই বলে একে , না ? এখন কাউকে অত কাকভোরে উঠতে হয় না ।  এখন বস্তা বস্তা ফুল কিনে আনা হয় , কৃষ্ণনগর থেকে।  সারাদিন কি ব্যস্ত ভাব আমার তখন ! যেন আমি না থাকলে কাজগুলো আর করবে কে ? বড়রাও বলত , " ভাগ্যিস তুই ছিলি ,নইলে এই কাজগুলো করত কে ? " এখন ভাবলে হাসি পায়।  ছোট্ট মেয়েটাকে অসীম গুরুত্বের  প্রশ্রয় দেওয়া  বয়স্ক মানুষগুলো আর নেই।  মেয়েটাও আর ছোট নেই।  
 
 
কালীপুজোর রাত।  বাড়িটাকে আলোয় আলোয় সাজানো হত।  এখন মনে হয় সত্যি কি সাজাতে পারতাম বাড়িটাকে ? ঐটুকু মোমবাতির আলো কত টুকুই বা ভরাতে পারত অত বড় বাড়িটার ? কিন্তু ভরে উঠতাম আমরা।  অমাবস্যার মিসকালো অন্ধকারে ছাদের পাঁচিলে জ্বলতে থাকা মোমবাতি গুলো দূর থেকে জানিয়ে দিত , ওটা আমার বাড়ি। 
 
 
আমাদের খুব ছোটবেলায় ইলেকট্রিসিটি ছিল না গ্রামে।  আমাদের ঠাকুরদালানটা  প্রাচীন। সংস্কার হয় নি তখনও।  ভেঙ্গে পড়া দেয়াল , ইঁট বের করা শ্যওলা ওঠা থাম।  নিশুত রাত , পুজো হচ্ছে।  দুধারে দুটো মশালের মত আগুন জ্বেলে।  সেই মশালের গনগনে আলোয় , কালো কালী মা। রক্তচক্ষু।  তার রক্তমাখা চরণতলে বসে খোকন কাকার উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারণ।  মাঝরাতে বলির ভযে ঘরে সিঁটিয়ে বসে থাকা আমি , আর বলির হাঁড়িকাঠ ঘিরে সম্মিলিত  পুরুষকন্ঠের " মা , মা " রব।  এই আমার কালীপুজো।  পুজোর সময় , আরতির সময় , বলির পরে পরতে পরতে বদলে যাওয়া মা এর মুখ , চাহনি , হাসি।  এই আমার কালীপুজো। 
 
 
#
 
 
জানি না আমার প্রজন্মের আর কজনের ভাগ্য হয়েছে এমন কালীপূজো দেখার।  আজকের  লেখা সেই সমস্ত পুরনো মানুষকে মনে করে , যারা আমার শৈশবে এমন দুর্লভ স্বাদাস্বাদ্ন করিয়েছেন আমায়।  ঠাম্মা , বাবা , গনেশ জ্যেঠু - সবাই।  গনেশ জ্যেঠু , যার ঠক ঠক ঠক ঠক লাঠির আওয়াজ আয়োজনের প্রত্যেকটা কোণকে ভরিয়ে রাখত আন্তরিকতায় , আপ্যায়নে , অভ্যর্থনায়।  কোথায় সেই বুড়ো মানুষটা ? আজ তাকে বড্ড দরকার।  বড্ড ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে আজ সবকিছু।  আমাদের প্রজন্ম পারে নি এত বছরেও ওই একটা মানুষের ছোঁয়াকে পরিপূরণ করতে।  আজ ও জায়গাটা  ফাঁকা। 
 
 
#
 
 
কালীপুজো মানে শুধু ছোটবেলা নয়।  কালীপুজো মানে বড়বেলাও।  কালীপুজো মানে বাবার  অচেতন , কাত হয়ে যাওয়া মুখটা নিয়ে পাগলের মত ডাকতে থাকা।  কালীপুজো মানে নিবে আসা আলোর শিখাটাকে অবুঝের মত জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করা।  কালীপূজো  মানে অন্ধকার রাস্তায় বাড়ি বাড়ি ছুটে বেড়ানো একটা স্তেথস্কোপের জন্য।  কালীপূজো  মানে বাবা আর বাবার মা কালী। আমার মা কালী।  বড় কাছের , বড় নিজের।  রক্তের মধ্যে মিশে যাওয়া একটা নাম , মা কালী।  একমাত্র অবিচল বিশ্বাসের  একটা নাম , মা কালী।  
 
 
তারপর থেকে আর কোনদিন কালীপূজো প্রজ্বলিত হয় নি আমার মনে।  এখনো তবু প্রদীপ জ্বালাই।  আনন্দ করি বা করার চেষ্টা করি।  " ত্স্মাচ্ছ্কং পরিত্যজ্য শ্রেয়সে প্রযতেদ বুধঃ। " মৃত্যু দেখে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।  সামনে যা করণীয় আছে , তা করে যেতে হবে।  তাই করে যাই।  থামি না।  তবু যেন জীবন থেমে যায় - এই একটা দিনের জন্য। 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
এলবামের পাতা থেকে উঠে আসা কিছু পুরনো ছবি