Friday, June 5, 2015

প্রতাপের বৌভাত 

একটি ধুসর স্মৃতি আলেখ্য 

 ........... রূপেন্দ্রনাথ দত্ত 



১৯৭৭ এর মে মাস।  প্রতাপের বাসি বিয়ের দিন , বিকেল বেলা। ইস্কুলে তখন বোধ হয় গরমের ছুটি। আমরা - অর্থাৎ , আমি , শচীন , মাণিক , জ্যোতি , গৌড়  এবং বোধ হয় আরও কয়েক জন - টিচার'স রুমে বসে আড্ডা মারছি। এমন সময়ে বিয়ের নতুন চটি - জুতো পরে [ যে চটি পছন্দ করার সময়ে কলেজ স্ট্রীটে প্রায় ট্র্যাফিক জ্যামের জোগাড়  হয়েছিল ] , হাতে ধুতির কোঁচা ধরে , আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে প্রতাপ হাজির।

আমি বললাম , " কি ব্যপার ? নতুন বৌ-কে ছেড়ে আজ তুমি এখেনে ? " প্রতাপ বল্লে - " আরে , তোমার খোঁজেই বেরিয়েছি। তোমাকে বাড়িতে না পেয়ে মনে হল এখানেই ঢু মেরে দেখি।  ভালই হলো - এখানে মানিক - টানিক সবাই রয়েছে। " এই না বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু টাকা বের করে আমায় বল্লে , " ধরো।  এতে সাড়ে  তিনশ' আছে।  কালকের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করো। "

আমরা তো হতভম্ব। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর ওকে জিজ্ঞাসাবাদ  ক'রে জানা গেল যে বামুনঠাকুর , যোগাড়ে , বাসনপত্তর - কিছুই ব্যবস্থাপত্তর হয় নি। ছাদে ম্যারাপ বাঁধার ব্যবস্থাও হয় নি।  নিমন্ত্রিতের সংখ্যা পয়ত্রিশ -চল্লিশের মতো , দু - পাঁচ জন বেশিও হতে পারে। কারণ , কাকে কাকে বলা হয়েছে , তার কোনো লিস্ট করা হয় নি। 

মানছি যে এই ২০১৫ -র তুলনায় চল্লিশ বছর আগে টাকার মূল্য ছিল অনেক অনেক বেশী , প্রায় অবিশ্বাস্য। কিন্তু তা হলেও সেই সাতাত্তর সালের বাজার দর এমন ছিল না যে ৩৫০ টাকায় চল্লিশ জনের বৌভাতের ভোজের আয়োজন করা যায়।  আমি একটু চিন্তা করে বললাম , " এক কাজ করলে কেমন হয় ? বাড়িতে লুচি আলুর দম তৈরী করা হোক।  তার সাথে দোকান থেকে কিনে এনে ফিস ফ্রাই , সন্দেশ , রসগোল্লা প্লেটে সাজিয়ে দিলেই হবে।  শেষে চা।  অনেকটা high tea এর মতো।  যদিও এটা পাত্পেরে ভরপেট খাওয়ানো নিশ্চই নয় , কিন্তু এর পর বাড়িতে গিয়ে খাবে , এমন লোক কমই আছে।  দেখতে শুনতে নেহাত খারাপ হবে না , আর এই টাকায় মোটামুটি ম্যানেজ হয়ে যাবে।  " আমার প্রস্তাব সবাই সোত্সাহে সমর্থন করলেও প্রতাপ veto প্রয়োগ করলো।  বল্লে , " ওসব ফক্কিকারি চলবে না।  যথারীতি পাত পেরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে " আমি বললাম, "এই টাকায়  সেটা কিভাবে সম্ভব ? " প্রতাপ বল্লে , "ওসব আমি জানি না।  আমার কাছে যা ছিল দিয়েছি।  এখন যেমন ভাবে পারো ব্যবস্থা করো। নইলে হেভী বেইজ্জতি হবে " এই বলে বাবু কোঁচা দুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

অগত্যা একটা প্ল্যান ছকে ফেলতে হলো। ঠিক হলো , প্রতাপের ঘরের বারান্দায় [এখন যেখানটায় রান্নাঘর , তখন ওটা ছিল না - ঘরেই রান্না হতো ] আমি রান্না করব , আর সবাই যোগাড়ে হবে।  খাওয়ানো হবে শম্ভুদার ঘরে এবং সম্ভব হলে ওদিকের বারান্দায়।  উনুন সমেত বাসনপত্রের লিস্ট ধরিয়ে সুশীলকে ধরিয়ে দেওয়া হলো , যাতে বোস ডেকরেটার্স থেকে পর দিন সকালেই সব প্রতাপের ওখানে পৌছে দেয়।  মেনু ঠিক হলো ভাতের সঙ্গে শুক্তো , নিরামিষ ডাল , ভাজা , মাছের মুড়ো দিয়ে ছ্যাঁচড়া , মাছের কালিয়া , চাটনি।  সাব্যস্ত হল ননীর দোকান থেকে নেওয়া হবে রাজভোগ আর দই।  আর আসবে বকুলদার দোকান থেকে পান। মেনু অনুযায়ী চাল , তেল , নুন , মশলাপাতি , কাঁচাবাজার ইত্যাদিরও ফর্দ তখনি করে ফেলতে হল । ঠিক হলো পরদিন সকালে ওই ফর্দ অনুযায়ী মালপত্র আমি-ই কিনে প্রতাপের ঘরে জমা করব , রান্না শুরু হবে দশটা - সাড়ে দশটা নাগাদ।  ওই সময়ে সবাই ওখানে হাজির হবে। 

বৌভাতের প্লান মাফিক কাজকর্ম শুরু হলো।  মুড অনেকটা পিকনিকের মতো। নানা কারণে অল্পবিস্তর রন্ধনকার্যের অভিজ্ঞতা আমার ছিল। কিন্তু যগ্গিবাড়ি কেন , নিজের বাড়ির কুটনো কোটার অভিজ্ঞতাও মাণিক , জ্যোতি , গৌরের ছিল না। আমার  নির্দেশে ওদের কূটনো কোটা প্রচুর হাস্যরসের যোগান দিল।  মাসিমা কিছুক্ষণ অন্তর চায়ের যোগান দিতে থাকলেন , প্রতাপ আমকে যোগান দিতে থাকলো পান আর আর সিগারেট।  হাসি , ঠাট্টা , গল্প গুজবের মধ্যে রান্না চলতে লাগলো।  নতুন বউ ঘরের মেঝেয় মাদুরের উপর ঘোমটা মাথায় বসে রইলেন। সুশীল আমাদের ফাই ফরমাশ খাটতে লাগলো। এই ভাবে দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল। রান্নাও প্রায় শেষ , শুধু ভাত  চড়ানো বাকি  - সেটা হবে সন্ধের পর।

সন্ধের পর ভাত চাপলো।  নিমন্ত্রিতরা একে একে আসতে শুরু করলেন। নিমন্ত্রিতের মধ্যে যাঁদের কথা মনে পড়ছে ত্নারা হলেন সপরিবারে ধীরেনদা , প্রতাপের মামার বাড়ির  লোকজন , মিন্টু , চন্দন এবং ওর দিদি মালা।  আমাদের মধ্যে যারা বিবাহিত ছিলেন - তাঁরা সস্ত্রীক সন্তানসন্ততিসহ।

যেহেতু খাওনোর জায়গা সীমিত এবং এক ব্যাচে আট-দশ জনের বেশি বসানো যাবে না সেহেতু আটটা এক ব্যাচ খেতে বসানো হলো।  এই সময় শুরু হলো বৃষ্টি - বেশ জোরেই।  এই সময়েই মাণিক ফাটালো প্রথম বোমাটা।  আমায় এসে বল্লে , " খেতে তো বসানো হচ্ছে , খাওয়ার জল কোথায় ?" খেয়াল হলো - সত্যিই তো - সময় মত কল থেকে খাবার জল তুলে রাখা হয় নি।  যদিও একটু দুরেই টিউবওয়েল রয়েছে , ওই বৃষ্টির মধ্যে সেখান থেকে জল আনা সম্ভব নয়। অগত্যা আমি বল্লাম , " কাউকে কিছু না বলে নীচের বাইরের চৌবাচ্চা থেকে বালতি করে জল তুলে এনে , তাই দিয়ে কাজ চালা।  " প্রতাপের একতলার বাইরের চৌবাচ্চাটায় প্রায় সব সময়েই কলের জল পড়ত এবং সেই জল কেউ কখনো বন্ধ করত না।  চৌবাচ্চাটা শ্যাওলা ধরা হলেও জলে অন্য কোনো রকম নোংরা থাকত না। সৌভাগ্যবান ওই চৌবাচ্চার জলই বর - কনে নিমন্ত্রিতরা এবং আমরা সবাই সে রাতে পান করে ধন্য হয়েছি। .

দ্বিতীয় বোমা ফাটল রাত সোয়া ন'টা নাগাদ। সচীন বল্লে , " ফুলশয্যা তো  হবে , নতুন শয্যার কী ব্যবস্থা হয়েছে ?" খোঁজ নিয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না।  তক্ষুনি সেই বৃষ্টির মধ্যেই সচীন দৌড়লো হাতিবাগান বাজারে।  মিনিট পনের পরে দেখি সচিন ভিজতে ভিজতে ফিরছে, আর ওর পেছন পেছন মুটে আসছে , তার মাথায় প্লাস্টিক চাপা দেওয়া তোষক , চাদর বালিশের মোট।

প্রতাপের কপাল জোরে এবং ওপরওয়ালার কৃপায় রান্নাগুলো উতরে গিয়েছিল।  সুতরাং অতিথি আপ্যায়ন - নানা অসুবিধে [ বিশেষত স্থানাভাব ] সত্বেও , খুব খারাপ হলো না।  বামুন ঠাকুরের কপালে বেশ কিছু প্রশংসা জুটল।  ইতিমধ্যে মেঘে মেঘে রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজলো।  লাস্ট ব্যাচ খেতে বসেছে। আগে খেয়ে নিয়েছে এমন দু'একজন পরিবেশন করছে।  তখন খেতে বাকি মাণিক , আমি , মাসিমা। মাণিককে খেতে বসাতেই হবে নইলে ওরা [ অর্থাৎ মাণিক , খুকু এবং ঝুম্পা ] বাড়ি ফেরার লাস্ট বাস ধরতে পারবে না।  অথচ খেতে বসানোর কোনো জায়গা নাই।

necessity is the mother of invention - প্রবাদবাক্য টা যে কতটা সত্যি সেটা সেদিন আর একবার প্রমানিত হলো।  দেখা শম্ভুদার  ঘরে খাটের সামনে অল্প একটু জায়গা খালি আছে যেখানে কোনো রকমে দুটো পাত - পাড়া যেতে যেতে পারে , কিন্তু বসার কোনো জায়গা নেই। বিনা বাক্যব্যয়ে মাণিক আর আমি খাটের তলায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম , শুধু মাথা দুটো রইলো বাইরে। মুখের সামনে দুটি পাত পড়ল।  আমরা দুজন ভুজঙ্গাসনে প্রতাপের বৌভাতের ভোজন পর্ব সমাধা করলাম। 


 

No comments:

Post a Comment