Friday, November 14, 2014

অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য 
জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া 
চক্ষুরুন্মিলিত্যং যেন 
তস্মেই  শ্রী গুরবে নমঃ। 
 
 
প্রাক সত্তর দশকের সেই উত্তাল সময়। 
 
যখন বাংলার যৌবন রাগে - ক্ষোভে - প্রতিবাদে - প্রতিরোধে ভিসুভিয়াসের মত টগবগ করে ফুটছে। বাংলার বুকের ওপর এক নব -অগ্নিযুযুগ নেমে এসেছে। ছেলেরা দলে দলে গ্রামে যাচ্ছে কৃষিবিপ্লবের আগুন জ্বালাতে।  শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছাত্ররা আগুন জ্জ্বালাচ্ছে।  কোন এক কবি লিখে ফেললেন , " স্কুল কলেজে  খিল / রাস্তায় মিছিল / ক্র্যকারে কাঁপে রাজপথ / কিনু গোয়ালার গলি / হীরের টুকরো ছেলেরা  সব অশ্বমেধের বলি । / বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোত্স্না। "
 
বাস্তবিক।  কলকাতার পথে পথে  সি. আর. পি -র পাহারা। ছাত্রদের গলায় স্লোগান , "পুলিশ তুমি যতই মার ,মাইনে তোমার  একশ বারো । " রক্তাক্ত রাজপথ।  স্কুল কলেজের সামনে সি.আর. পি -র গুলিতে ঝাঁঝরা ছাত্রদের লাশ। 
 
৬৫।  দিল্লির মসনদে ইন্দিরা গান্ধী।  পাকিস্তানের  যুদ্ধ। কিছু পরেই তাশখন্দে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর বিতর্কিত মহাপ্রয়ান।  ছাত্রদের মিছিলে আওয়াজ ওঠে " দেশবাসী যখন চায় বস্ত্র ও খাদ্য / সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য। "  সে মিছিলে মেহনতী মানুষ ও সামিল। 
 
এই অগ্নিময় মহাযজ্ঞে আমার ছোট অনামী ইস্কুলের উঁচু ছাত্রবন্ধুরাও সামিল।  মুখ্যত যাঁর নেতৃত্বে , তিনি আমাদের নবাগত শিক্ষক শ্যামসুন্দর বোস।  ইংরেজির শিক্ষক ; কিন্তু , পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমাদের রাজনীতির ক্লাসও নিতে শুরু করলেন।  বোঝালেন মার্কস বর্ণিত সমাজবিবর্তনের ধারাপাত। বোঝালেন , শুরুতে কেউ ই অতুল ধনসম্পত্তি নিয়ে জন্মায় নি।  শুরুতে যখন  আদিম সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত  ছিল , তখন মানুষ দলবদ্ধ ভাবে কৌমজীবন যাপন করত।  ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু ছিল না।  লড়াই হত বন জঙ্গলের অধিকার নিয়ে দলের সঙ্গে দলের।  আর সাধারণ শত্রু ছিল হিংস্র পশু ও বন্য স্বাপদের দল।  পরে কৃষিযুগ থেকে দলপতিদের ভোগী জীবনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি , সঞ্চয়লালসা ইত্যাদি সামাজিক পাপের উদ্ভব। 
 
বোঝালেন , দ্বান্দিক বস্তুবাদ।  বস্তুই ভাবের জনক ।  রবীন্দ্রনাথ ভুল বলেছেন , " আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ / চুনি উঠলো রাঙ্গা হয়ে।  " - না।  কারুর চেতনার রঙে পান্না সবুজ হয় নি।  চুনি রাঙ্গা হয়ে ওঠে নি।  পান্না সবুজই।  তাই , আমাদের চেতনায় , তা সবুজ বলে প্রতিভাত হয়।  চুনি নিজে রাঙ্গা বলেই আমাদের চেতনাকে রাঙিয়ে তোলে।  বস্তু থেকেই ভাব চেতনার জন্ম।  কথায় বলে " আছে বস্তু , তায় বিচার " এর অন্যথা হলে তাকে নির্বাস্তু ভাববাদ বলা হবে ।  যা বস্তুত পক্ষে অলীক ও নিরালম্ব। 
 
 
এমনই উত্তুঙ্গ সময়ে মূলত সংস্কৃত পড়ানোর জন্য ইস্কুলে একজন নতুন শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটল।  প্রতাপাদিত্য গঙ্গোপাধ্যায়।  বছর ২৪-২৫ বয়স মেরে কেটে।  আমরা তখন ক্লাস নাইন। বয়সটা সহজেই অনুমেয়।  কাজেই শিক্ষক না হয়ে অচিরেই যে তিনি 'দাদা' হয়ে উঠবেন , বলা বাহুল্য।  যদিও আমি কখনো দাদা বলি নি।  'স্যার' ই বলে এসেছি বরাবর। 
 
একেবারে ক্লাস টিচার হয়ে এলেন। প্রথম পিরিয়ডে 'বাংলা ' এবং টিফিনের পর , অর্থাৎ , ফিফথ পিরিয়ডে সংস্কৃত। 
 
খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন - বলতে পারব না।  বরং , ঠিক উল্টো ।  পরীক্ষার হলে 'বাঘ ' হওয়ার সুত্রে ছাত্রদরদী ভাবমূর্তিতে টান।  তিনি নাকি ডান দিকে ফিরে বাঁ দিকটা নজর রাখতেন।  যা নজরদারির পক্ষে একেবারে বিরল ব্যতিক্রম।  এবং নকলনবিশ ছাত্রদের পক্ষে সমূহ বিপজ্জনক।  যদিও সে অভিজ্ঞতা আমার কখনো হয় নি।  কারণ , স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত কোনদিন ও নকল করার কলাকৌশল গুলো আয়ত্ত করতে পারিনি।  এটি আমার অন্যতম অক্ষমতা।

সে বছর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় সংস্কৃতে একশোর মধ্যে পনের  পেলাম।  সে খাতা তো আর গার্জেনদের দেখানো যায় না - তাই,  পত্রপাঠ সে-খানি কুচিয়ে শতছিন্ন করে স্যারের সামনেই ডেস্কের উপর ছড়িয়ে দিয়ে এলাম।  আর ,পড় তো পড় , সেই মুহুর্তেই পিরিয়ড শেষের ঘন্টা পড়ে গেল।

স্যার তো স্তম্ভিত।  ছাত্রের স্পর্ধায় হতবাক। যাবার সময় খালি  জলদমন্দ্রে বললেন , " ছুটির পর দেখা করবি।  "

স্যারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরা আমায় নিয়ে পড়ল। এই মারে তো সেই মারে ! "আর দেখতে হবে না।  এ বছর ঠিক ফেল মারবি।  ক্লাস টিচারকে চটিয়েছিস ! " কেউ বলল , " ছুটির সময়ে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিবি। .." ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কিন্তু পরের ঘটনা যা ঘটল, তাতে কোনো হিন্দিভাষী হলে বলতাম 'পিকচার অভি বাকি হ্যায়  ওস্তাদ।  ইয়ে গুরু শিষ্যকা সওয়াল।  বিচ মে ঘুস না মানা হ্যায়। " বিশেষত সে কেস যখন রণেন্দ্র-প্রতাপে। 

ছুটির পর দুরু দুরু যখন টিচার'স রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম,  কপালে বিন বিনে  দিয়েছে , গলা শুকিয়ে কাঠ।  তখন তো আর এখনকার মত ওয়াটার বটলের রেওয়াজ ছিল না - তাই প্রায় ঠোঁট চাটতে চাটতেই তাঁর সম্মুখীন হলাম। 

বললেন , "ব্যকরণ কৌমুদীটা বার কর। " করলাম। 
-" হেল্পস টু স্টাডি এনেছিস ? "
 বললাম , " হ্যা "
- " বার কর।  " যথা নির্দেশম তথা কৃতম। "
বললেন , "কৌমুদী থেকে "নর " আর " লতা " শব্দরূপ দুটো , "ভূ " আর 'গম ' ধাতুরূপ দুটো , আর এ বইটা থেকে চতুর্থী পর্যন্ত বিভক্তির সুত্রগুলো মুখস্ত করে , কাল সকাল ঠিক সাতটায়  আসবি।  "
মিনমিন করে বলতে গেলাম , "আপনার বাড়ি তো  আমি চিনি না স্যার। ......... " এক থাপ্পরে সে কথা থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন , "তোর  বন্ধুদের অনেকে আমার বাড়ি চেনে। তাদের কাছ থেকে জেনে নিবি। এখন যা - চলে যা। "

বন্ধুরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল , প্রতাপবাবুর হাতে রণেনের কী দুর্দশা হয় তা স্বচক্ষে চাক্ষুষ করবে বলে। জিজ্ঞেস করতে সত্যিই জানা গেল প্রণবের পাড়াতেই উনি থাকেন ; হাতিবাগানের দিক থেকে হরি ঘোষ স্ট্রীটের প্রথম বাড়িটাই।  দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডান দিকে প্রথম ঘর।

তারপর সে এক অসাধ্যসাধনের ইতিকথা।  যা কখনো করি নি - তাই করলাম।  প্রায় সারা রাত্রি জেগে মুখস্ত করলাম।  ছোটবেলা থেকেই আবৃত্তি করার সুত্রে মুখস্তবিদ্যেটা প্রায় করায়ত্ত। 
পর দিন  গুটি গুটি পায়ে স্যারের দোতলার বারান্দাওয়ালা ঘরটিতে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন পাক্কা সওয়া সাতটা। 

 এই শুরু হলো পরশ পাথরের ছোঁয়ায় এক মরচে পড়া লোহার নবজন্মের বৃত্তান্ত।  প্রতিদিন।  প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে সারে নটা। তারপর বাড়িতে এসেই স্নান খাওয়া সেরে স্কুলে দৌড়োনো। এগারটায় ক্লাস।  প্রথম পিরিয়ড আবার তাঁরই।  এক মিনিট দেরী হওয়ার  জো নেই।  তাহলেই গেটের বাইরে নীল ডাউন।

এদিকে রাজনীতির প্রভাবে এবং সময়ের প্রভাবে ততদিনে জেনে গিয়েছি ,যে  এ শিক্ষাব্যবস্থা কত ভুয়ো ; এই বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে যত বেশি ডিগ্রী পায় , সে তত বড় গর্দভ।  কাজেই , বৃহত্তর গর্দভ হওয়ার দিকে আমার কোনো ঝোঁকই দেখা  গেল না।  অনেক পরে বুঝেছি , সেটা ছিল আমার ফাঁকিবাজির একটা জুৎসই কৈফিয়ত মাত্র।  শুধু আমার নয় , আমাদের।  আমাদের প্রজন্মের হতভাগ্য কিশোর কিশোরীদের।

কিন্তু আর একটা মতও  সমান্তরাল ভাবে এসে পৌছচ্ছিল। দ্বন্দের নিয়মে সব কিছুরই দুটো দিক থাকবে - ইতিবাচক আর নেতিবাচক।  তাহলে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থারও নিশ্চই দুটো দিক আছে।  তার নেতিবাচক দিকটা পরিহার করলেও , ইতিবাচক দিকটা গ্রহণ করতে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন ! সেই বয়সে এই তত্তের প্রবক্তা হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রতাপবাবু স্যার।

তিনি বোঝালেন , "কোনো জিনিস পরিহার করতে গেলেও জানতে হবে , কী কী কারণে তা পরিহর্তব্য।  আর তা গ্রহণ করতে গেলে তো জানতে। হবেই।  খানিকটা রামকৃষ্ণের পরমহংস তত্তের মতো ; দুধে জল মেশানো থাকলে হাঁস নাকি দুধ টুকুই পান করে , জলটা পরে থাকে।  আমাদের তেমনি বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে তার সারটুকু , অর্থাৎ সদর্থক অংশটুকু পান করে , 'অসার ' অংশটুকু বর্জন করতে হবে।  -  মোদ্দা কথা , না পরে "সব ঝুট হ্যায় " বলাটা কোনো মতেই মার্ক্সীয় পথ নয়। স্বয়ং মার্ক সাহেবকেও তাহলে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে হত না।  'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ' বইতে বিবেকানন্দ তো বলেইছেন , " ইলিশমাছ রইলো গঙ্গায় আর তুই ঘরে বসে ইলিশমাছ  ত্যাগ করলি , তো তাতে মাছের-ই  বা কি এসে গেল ,তোরই বা কি এলো গেল  ! আগে মাছ খা  , তার স্বাদ জান , তারপর ত্যাগ কর ; তখন বুঝব। " অর্থাৎ  খন্ডিত জ্ঞান নিয়ে শুধু সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নই দেখা যায় , যথার্থ পরিবারতন আনা যায় না ।   মার্কস থেকে  মাও সে তুং পর্যন্ত সব প্রবক্তারাই তাঁদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাতেও প্রচুর পড়াশুনা করেছেন।

দুই তত্তের দড়ি টানাটানিতে আমাদের প্রায় ধস্ত-বিধস্ত অবস্থা।  এবং স্বাভাবিকভাবে আমার মতো আরও অনেকেই সহজ রাস্তাটাই বেছে নিল। 

দেখতে দেখতে অ্যানুয়াল পরীক্ষা এসে পড়ল।  ভালো রেজাল্ট করার ছিটেফোঁটা মোহ -ও তখন আর বিদ্যমান নেই।  পরীক্ষার হলে বসে শুধু মাত্র পাসমার্কসটুকুর উত্তর লিখে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে আসতাম।  ফলে যা হবার তাই হলো  কিন্তু সে কথা পরে হবে।  তার আগের কিছু ইতিবৃত্ত আছে।  সেটি না বললে সম্যক বিষয়টি বোঝা যাবে না। 

তখন হেডমাস্টারমশাই অমুল্যজীবন ভট্টাচার্য।  তাঁর নেতৃত্বে প্রতি বছর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো ঘটা করে।  সে বছর নাটক হবে - অখিল নিয়োগীর 'আত্মহত্যা। ' একটি ফেল করা ছেলের মজাদার কাহিনী।  ছেলেটির নাম 'বিমান। ' যে চরিত্রটির অভিনেতা আবার এই অধম।  অভিনয় ছাড়া যথারীতি আবৃত্তি তো আছেই। 

আমার বাছাইএর মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের 'আফ্রিকা' কবিতাটিও।  কেন জানি , উনি বার বার ঐ কবিতাটি আমার মুখে শুনতে চাইতেন।  রিহার্সালে প্রায় দু তিন বার তো বলতে হতোই।  একদিন জিজ্ঞেস করলাম , "স্যার , আফ্রিকার মধ্যে এমন কী আছে - যে বার বার শুনেও আপনার আশ মেটে  না ! "  বললেন , "তোর্ ঐ 'উদ্ভ্রান্ত ' শব্দটা উচ্চারণের মধ্যেই আমি একটা দিশেহারা সময়ের উথাল পাঠাল ছবি সপষ্ট দেখতে পাই। " আমার আবৃত্তি নিয়ে অনেকের অনেক প্রশংসা শুনেছি।  কিন্তু জীবনের ঊশা লগ্নের এই কটি কথা আজ-ও  সোনার আখরে বুকের মধ্যে গাঁথা  হয়ে আছে।

সে যাই হোক , রেজাল্ট বেরোবার দিন এগিয়ে আসছে।  আমাদের রিহার্সালও প্রায় শেষের দিকে।  পরীক্ষার পর পরই  শুরু হয়েছিল , প্রায় এক মাসের টানা রিহার্সাল। পার্ট মুখস্ত , মিউজিক  রিহার্সালও নিয়মিত চলছে।  এহেন সময়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত রেজাল্টের দিন ঘোষণা হলো।

রেজাল্টের দিন প্রথা -অনুযায়ী হেডমাস্টারমশাই এসে রোল ধরে ধরে পাশ করা ছেলেদের নাম ডাকেন।  যাদের নাম বাদ পড়ল বুঝতে হবে তারা 'ফেলু। ' অন্যবার আমার নাম ঘোষণা হলেই কিস্কিন্ধাপতির নেত্য শুরু করে দিই।  কিন্তু এবার। ... অবাক কান্ড !
-তিরিশ - সন্দীপ দত্ত -
-ইয়েস স্যার ! সন্দীপ গিয়ে হেডমাস্টারের হাত থেকে রেজাল্ট সীটটা নিয়ে এলো। 
-একত্রিশ।  নৃত্যকালী ঘোষ  -
-ইয়েস স্যার !
-পৈত্রিশ ! অনন্ত ভৌমিক -

একী ! আমার রোল নম্বর কোথায় গেল !তেত্রিশ ! কে যেন পাহাড়ের ওপর থেকে এক ঠেলা মেরে আমায় গভীর খাদের মধ্যে ফেলে দিলো।  দু চোখে অন্ধকার  ....... কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো  ....... বুকে লক্ষ হাতুড়ির শব্দ। .. কতক্ষণ এরকম ছিলাম জানি না - হঠাৎ মনে হলো , আমার দু চোখের কোল বেয়ে উষ্ণ প্স্রবন নেমে আসছে।  ভিষণ লজ্জা পেলাম।  এ বাবা , চোদ্দ বছরের একটা ছেলে সবার সামনে  ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে ! তাড়াতাড়ি  হাত দিয়ে মুছতে গিয়ে দেখলাম , উরিব্বাস ! সেখানে জলের লাইন পরে গিয়েছে , হাতের আড়াল ঠেলে তারা হুড়োহুড়ি  করে বেরিয়ে আসতে লাগলো।  আমি তাড়াতাড়ি বেঞ্চির উপর মুখ রেখে দু হাতের কান্ডার করে লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম।  ব্যর্থ ; এবং কারো - কারো কাছে হয়তো হাস্যকরও। 

বাস্তবিক , সেই মুহুর্তের আগে বুঝতেই পারি নি যে 'পরীক্ষা ' নামক বাজে সিস্টেমটাকে আমি ভেতরে ভেতরে তখনো অত গুরুত্ব দিয়ে চলেছি। এ আঘাত আমার জীবন জুড়ে এক গভীর খাত সৃষ্টি করলো।  জীবনের ঊষাকালের নরম মনটাকে কে যেন কশাঘাতে - কশাঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দগদগে  ঘা করে তুলল।  যে আমি  ভাবলোকের শরত আকাশে পরমানন্দে মেঘ সাঁতরে বেড়াচ্ছিলাম , কে যেন সেই উত্তুঙ্গ উচ্চতা থেকে সশব্দে  রুক্ষ মাটির উপর আছাড় মারলো। বাস্তবিক , ছাত্র জীবনে ফেল করা যে কী নিদারুন প্রাণান্তকর যন্ত্রণা , যে না করেছে তাকে বোঝানো যাবে না। 

হেডমাস্টারের সঙ্গে ক্লাসটিচার হিসেবে প্রতাপবাবুও ছিলেন।  তিনি সম্ভবত প্রিয় ছাত্রের এই মর্মান্তিক যন্ত্রণা লক্ষ করেছিলেন।  ভিতরে ভিতরে তাঁর অন্তরটাও কী দীর্ণ বিদীর্ণ হয় নি ! কে জানে। ..! .... অবশ্যই হয়েছিল।  তাঁর মত  অপরের যন্ত্রণা  দেখে দেখে কখনই স্থির   পারে না।  কিন্তু সেই মুহুর্তে তাঁর-ই বা কী করার ছিল ! আমার মত তিনিও তো তখন সিস্টেমের হাতে অসহায়।



 


সত্তর দশকের এক ব্যাচেলর'স রুম। .. 44 গ্রে স্ট্রীট


( পরবর্তী পর্ব আগামী শুক্রবার )

10 comments:

  1. Mugdho lekha pore.... Mone hocche amio oi class tar kono ek benche bose achi. Agami sukro barer apehhai achi.

    ReplyDelete
  2. guru shishya r samparko prithibir ek aloukik daan.je daan grahan korar souvagyo aneker e hoy na.kintu jader hoy tara swargo sukh anuvab kore marter matitei.kivabe snehe shasone adore shikhkhay, ek pabitra tamo sakor janmo hoy....jar ek paare theke guru arek pare shishya,ta sudhu tarai anuvab kore.guru r shishya takhon parosparer atmar taane bandi hoye jay.ja amrityu chaya hoye thake shishyar mathar opor.ei smriticharona njr jibaner bahu smriti k uske dilo.dhonyobaad janai lekhak k o jini post kore sujog kore dilen porar takeo.parer parbo gulo o jate evabei janasamakhke pai.abedan roilo.ek apuorup akhyan hote choleche ei lekha,ja ekisathe sraddhanjali, onyodike udaharon....prithibir aloukik pabitra ek bandhaner....

    ReplyDelete
    Replies
    1. Nijer vitorer chalonashokti holo Guru . Nijer vitorer bodh , adorsho , shuvo chetana , sanjam , r shidhanto .. sabetei jaar alakkho pravab anuvab kora jay sei Guru . Baba kei Guru mani,

      Delete
  3. u r the best daughter.....

    ReplyDelete
    Replies
    1. ama baba cholegechhen 6 bochhor hote chollo,aj porjonto ami onar chhobite mala dewa to durer kotha ekti chhobi o dewal a tangai ni.baba sobsomy bolto "amake mone rakhbi jotodin mone dhorate parbi,chhobi tamgiye,seta dekhe jor kore mone rakhis na"...uni achhen ..amar sathei achhen..take mrito bhabte jabo keno?

      Delete
    2. Atasi , thanx re . Prottek meyei bodh hoy chay .. best daughter hote . So its a great compliment. R jaa bolechhis , ekebare thik bolechhis . Chhobi amar ghar eo rakhte pari ni .. darker o hoy ni ... ekhono chokh khule- chokh buje .. je kono obostha tei asahay mukh ta dekhte pai. Kaku ei biboroni ta likhche... ami nijeo anek ajana dik jante parchhi manush tar

      Delete
  4. harie felar bedona ki amio jani khanikta.....majhe majhei take dekhte,chhute,tar sprosho gandho pete vison ichchhe kore... ami tokhon tokhon e chokh bandho kore feel kori.. monta santo hoe jae, vore othe..ami feel kori sei samosto harie jaoa anuvuti..tai ami jani se nei..but ami mani na se nei... se achhe..aj o achhe..amar sab khusite,sab bedonae,smritite...se achhe amar hriday majhare.....

    ReplyDelete
  5. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  6. Guru-shishya-samporko binyase atmonchoner je manasveeti chilo apnader valo lagay taa muhurte vanish hoye gelo . Evabe utsaho pele , bola jay na , nirabaran satyakothoner fuljhuri chhutte pare . Tokhon kintu thamate chaileo thamar upay thakbe na .

    ReplyDelete
  7. Subhashish MukherjeeJanuary 11, 2015 at 12:02 AM

    path jar guru anugami
    tar haate udbe nishaan
    se anbe barta agami
    satyer jwale dhara snan

    apnar ei akopot satyoi bhusan eI lekhar,theme jay manusher mon, satyo thameni,thamena....tai thamar prosno nei....egie chalun...ranendranath dhara

    ReplyDelete