Friday, November 21, 2014


গুরবে  নমঃ 

( দ্বিতীয় পর্ব  )

                                                                 - রণেন্দ্রনাথ ধাড়া 

 
 


তারপর , 'বিষাদসিন্ধুর'র সে এক সুদীর্ঘ আখ্যানগাথা।  কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না।  কোনো কাজে মন বসে না।  একলা থাকলেই দুচোখ জলে ভরে ওঠে।  এক এক সময়ে বিষন্নতা এতই ঘনিয়ে আসে যে , সিঁড়ির কোণে  কি বাথরুমে গিয়ে বেশ খানিকটা অশ্রুমোচন করে এসে স্বস্তি পাই।

মনে হয় জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে গেল।  যে আমি সকলের চোখের মণি , যে সর্ব বিষয়ে ইস্কুলের প্রতিনিধিত্ব করে থাকি , সে আমি হেডমাস্টারের এক ঘোষণায় লাস্ট বেঞ্চের মার্কামারা ফেলুরামদের দলে পড়ে গেলাম !! নাঃ , এ অসহ্য ! কিছুতেই এ পরাজয় মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। 

নিচু ক্লাসের ছেলেরা , যাদের চোখে এতদিন আমি ' হীরো ' ছিলাম , এবার তাদের সঙ্গে এক ক্লাসে পেছনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসতে হবে ! অসম্ভব !

অনেক পরে , বাম সরকার যখন পাশ - ফেল প্রথা তুলে দিলো , তখন ভুক্তভুগী হিসেবে তাকে সমর্থন না-করার কোনো কারণ খুঁজে পাই নি। 

নিউটনের তৃতীয় সুত্র বলে , প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমপরিমাণ প্রতিক্রিয়া থাকবে। তো ,আমার 'ফাঁকিবাজি' নামক ক্রিয়ার এই যদি 'প্রতিক্রিয়া' হয় তাহলে 'প্রতিক্রিয়াও' তো একটা 'ক্রিয়াই।' তারও তবে সমপরিমাণ প্রতিক্রিয়া হতে-ই হবে। এবং সেই প্রতিক্রিয়াতেই আমার উন্মুক্ত রাজপথে চলা মনটা  অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে গলিখুঁজির মধ্যে ঢুকে পড়ল। 

হেডমাস্টারকে গিয়ে সরাসরি বললাম , "স্যার , বাড়ি থেকে বলেছে ,'এই রেজাল্ট করে তোমাকে আর নাটক করতে হবে না। আপনি আমায় বাদ দিন। " 'ব্ল্যাকমেল ' কথাটা তখনও শুনি নি ,  আহতমর্যাদাবোধ অজান্তেই আমাকে সেই পথে চালিত করলো , কোথায় যেন পড়েছিলাম , "Necessity is the mother of all inventions "  আমার উঁচু ক্লাসে ওঠার তীব্র "নেসেসিটি'-ই আপন অজ্ঞাতে আমাকে দিয়ে 'ব্লাকমেল' নামক মন্দ কাজটি 'ইনভেন্ট' করিয়ে নিল।

হেডমাস্টারমশাই স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকালেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন , "বাবাকে কাল আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস।" বুকের মধ্যে আসার বিদ্যুত হঠাৎ  ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

হেডমাস্টারের সঙ্গে কী কথা  হয়েছিল জানি না ; বাড়ি ফিরে বাবা বললেন , " তোমাকে আর ক্লাসে উঠতে হবে না। ঐ ক্লাসেই পড়ো। " পরে দাদুকে বলছেন শুনলাম , হেডমাস্টারমশাই নাকি ওকে দিয়ে বন্ডে সই করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।  দেহে মনে শক্ত মনের মানুষ বাবার পক্ষে তা কখনই সম্ভব ছিল না। মুচলেকা দিয়ে ছেলেকে ক্লাসে তলার চেয়ে তিনি বরং ছেলেকে নীচু ক্লাসে রাখতেই বেশী পছন্দ করবেন - এটাই স্বাভাবিক। 

নাটক যথারীতি আরম্ভও হলো।  এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারটিও আমার কপালে জুটল। কিন্তু সে পুরস্কার ও তখন বিষাদ।  ক্লাস শুরু হলে কীভাবে নতুন ছেলেদের সঙ্গে এক ক্লাসে গিয়ে বসবো - সেই চিন্তায় রাতের পর রাত ঘুম ছুটে গেল।  দুর্গা -কালী-শিব-কৃষ্ণ থেকে শেতলা , ষষ্ঠী -ওলাবিবি পর্যন্ত সকলের পায়ে মাথা ঠুকতে লাগলাম , "এই লজ্জা থেকে আমাকে মুক্ত কর ঠাকুর। "

কিন্তু কোনো ঠাকুরই কিছু করলো না ; নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে নতুন ছেলেদের সাথে পুরনো ক্লাসে এসে ঢুকলাম। 

নতমস্তক ; কারুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।  বুকের মধ্যে যন্ত্রণাদীর্ণ রক্তক্ষরণ। .. চোখের আড়ালে হিমায়িত অজস্র অশ্রুকণা  ... আগের ক্লাসের পুরনো বন্ধু যারা ছিল , পিছনের বেঁচে স্বেছাসন নিয়েছে।  নিঃশব্দে গিয়ে তাদের পাশে ঠাঁই নিলাম। চোরা চাউনিতে অনুভব করলাম কয়েকটি বক্রদৃষ্টি আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হায় রে , ওরা তো জানে না , প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে এই অবমাননার দ্বীপে আমি আজ স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি ; স্বখাত সলিলে ডুবে মরেছি। 

নতুন বন্ধুদের (!) সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু হওয়ার  আগেই ক্লাসটিচার এসে ঘরে ঢুকলেন।  হ্যা  , প্রতাপবাবুই। এসেই চোখ তুলে বললেন , "ধাড়া , তুই ওখানে কেন ? সামনে এসে বোস। " প্রথম বেঞ্চের ছেলেরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের পাততাড়ি সরিয়ে এনে বেঞ্চের দু ধার দখল করে নিলো।  উদ্দেশ্য কোনো ভাবেই আমি যেন সেখানে প্রবেশাধিকার না পাই। স্যার বললেন , তুই মাঝখানে ঢুকে গিয়ে বোস। " যথা নির্দেশম তথা কৃতম। ভেতরে ভেতরে গজরালেও কারো আর কিছু বলার সাহস হলো না ; প্রথম দিন বলেই বোধহয়।  পরে অবশ্য প্রান্তবাসী বন্ধুদ্বয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব বেশ গাঢ়-ই হয়েছিল।

কিন্তু সে অনেক পরে। মাঝখানে প্রায় মাস ছয়েকের দীর্ঘ প্রস্তুতি।  অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক। ব্যথা বেদনা যতই থাক , ওই বয়সে  বন্ধুহীন   থাকা যায় না।  কিন্তু আমার ব্যপারটা একটু অন্য রকম ; টিফিন  টাইম-এ কি সিঁড়িতে পুরনো বন্ধুদের দিকে চোখ তুলে চাইতে পারি না , অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে  নিই। ওরাও বিষয়টা খুব উপভোগ করে না নিশ্চই , কিন্তু আমি হীনমন্যতার আঁধার গহ্বরে কুঁকড়ে বসে থাকি।  বুঝতে পারছিলাম , আমি মানুষটা আপাদমস্তক  পাল্টে যাচ্ছি।  যেটি কখনই বাঞ্ছিত পরিবর্তন নয়। কিন্তু আমি নিতান্তই অক্ষম।  গড়ানে - গোলকের ধর্মে অবিরতই নীচের দিকে গড়িয়ে চলেছি।  তখন খড়কুটোর মত নতুন বন্ধুদেরই আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হলাম। হীনমন্যতা মানুষকে  হীন কাজ করিয়ে নেয়।  আগে যা কখনোই পারতাম না , এখন  মনকে দুবার ভাবতে হলো না।  প্রথমেই যা করলাম , তাহলো আস্তিকতা বর্জন , ঈশ্বরবিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দেবার প্রক্রিয়া শুরু করলাম প্রবলভাবে।  যার সূচনা হলো পুজোর ছলে ঠাকুর ঘরে গিয়ে আমাদের গৃহদেবতা গোপাল ঠাকুরকে দু পায়ের পাতার ওপর বসানোর মধ্য দিয়ে। কারণ , গোপালের কাছে আমি প্রথম কাঙালের মত প্রার্থনা করেছিলাম ,"আমাকে ক্লাসে তুলে দাও ঠাকুর " - তিনি সে প্রার্থনা রাখেন নি। এভাবেই নাস্তিকতার যুক্তিতে নিজেকে শানিত করে  তুলতে লাগলাম। যদিও সে যুক্তি খুব বেশি খুঁজতে হয় নি। কারণ , যে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছিলাম , তাতে ধর্মকে বলা হয় - আফিঙ। তার বহুবিধ যুক্তি থরে থরে বইগুলোতে সাজানো। সেগুলো আমার নাস্তিক্য অর্জনের পক্ষে অত্যন্ত সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে।

আর সংকল্প নিলাম , যে আঘাত আমি পেয়েছি , তার শতগুণ প্রত্যাঘাত করতে হবে। কাকে !!! কী জানি ! হয়ত সমাজকে , হয়ত শিক্ষাব্যবস্থাকে , অথবা , হয়ত বা নিজেকেই !

প্রতিজ্ঞা করলাম ভালো ছেলে ' ভাবমূর্তি নিয়ে তো এই ফল হলো ! এবার খারাপ হব।  যতদুর খারাপ হওয়া যায় , কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম হবো , হবোই। এখানেও সেই নিউটনের তৃতীয় সূত্র।

এই অবকাশে আমার বাড়ির কথা একটু বলি , যা এতক্ষণ প্রায় অব্যক্তই রয়ে গেছে।  বাড়িতে , দাদু- দিদা-মা- বাবা ছাড়া আমরা  ; বোন  নেই। 
আর মেয়ে না থাকার কারণে মায়ের আমার বিশ্বগ্রাসী কন্যাতৃষা।  তাই , পাড়ার যত মেয়ে আছে সকলের আবদার আমার মাকে ঘিরে।  কাজেই , ছোটবেলা থেকে মেয়েদের দঙ্গলের মধ্যেই বড় হয়েছি , ভাইবোনের মত। আর মায়ের ছোট ছেলে হওয়ার  সুবাদে সেই মেয়েদের সঙ্গে আমার সখ্য ছিল গলায় গলায়। ছেলেবেলায় ক্রিকেট ফুটবল যত না খেলেছি , তার চেয়ে এক্কা দোক্কা বউ বাটি , বুড়ি ছোঁয়া , কুমিরডাঙা খেলেছি অনেক বেশি।

সেই মেয়েদের মধ্যে জনৈকা শেতাঙ্গিনী ব্রাহ্মনকন্যার কি মতিচ্ছন্নতা ধরেছিল , বেশ কিছুদিন ধরেই ঠারে ঠোরে আভাসে ইঙ্গিতে আমাকে প্রেম নিবেদন করতে শুরু করেছিল।  আমি যথারীতি তাকে পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে চলতাম।  এবার মনে হলো কেনই বা তাকে এড়িয়ে চলব !ওই তো আমার জাহান্নামের পথের দোসর হতে পারে। তাকে প্রশ্রয় দিলাম। গুরুত্ব দিতে শুরু করলাম।  আমার এই আকস্মিক ভাবান্তর তার মনে কী  প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো জানি না , তবে এতদিন যা ছিল আভাসমাত্র , হঠাৎ তা যেন তার দিকে অতি মাত্রায় প্রকট হয়ে উঠলো ।   আমি তো নিজের রাশ আলগা  করেই দিয়েছিলাম , সেই ফাঁক দিয়ে তার দুকুলপ্লাবি বন্যাপ্রেম বন্যার মত প্রবেশ করে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল।  বাস্তবিক , এক চোদ্দ বছরের কিশোর কিশোরীর শরীরে এত রহস্য , এত মাদকতা লুকিয়ে আছে স্বপ্নেও ভাবি নি।  ওর  শরীরীপ্রেমের মদিরতাময় লালসা-পিচ্ছিল পথে ও নিরন্তর আমায় টানতে লাগলো।  হয়ত আমার ভালবাসার ফাঁকি ও ধরতে পেরেছিল। তাই নিজের শরীর ভেট দিয়ে খুশি করে আমায় বাঁধতে চেয়েছিল। কিন্তু ,অচিরেই আমার অবস্থা কাহিল  উঠলো , সে এক প্রাণান্তকর দুর্দশা।  শুনেছি , প্রেমে নাকি এক অপার্থিব অসীম মাধুর্য আছে , সে মধুরতার সন্ধান আমি একেবারেই পাই নি বললে ভুল হবে। তা হলো মদিরতার  মাধুর্য। ; পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মত যা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ; এবং ক্লান্তিকর ও বটে।

' চিত্রাঙ্গদা'য় অর্জুনের সেই হা হুতাশ মনে পড়ে।  "ভস্মে ঢাকে ক্লান্ত হুতাশন ,/ এ খেলা খেলবে আর কতক্ষণ ,/ হে ভগবান। " বাধ্যতামূলক প্রেমের অভিনয় মনকে বড়ই কলুষিত করে , যন্ত্রণাদীর্ণ করে।   অথচ 'পালাবারও পথ নাই। '

ফেল করার পরেই লজ্জায় অভিমানে প্রতাপবাবুর বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছি। তখন আমার নোঙ্গর কাটা নৌকোর মত এলোমেলো ভেসে চলার স্বাধীন দুর্ভাগ্য।  কী ভাগ্যিস , বন্ধুদের মধ্যে পানাসক্ত কেউ ছিল না , না হলে হয়ত পানাদোষ ও ধরে যেত।  সমস্ত দেহ মন জুড়ে তখন রুক্ষতার জয়গান।  বাড়িতে বাবার পেল্লায় পিটুনি খাচ্ছি ; কিন্তু তা-তে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।  সমস্ত সংসারের উপর রাগের ঝাল মেটাচ্ছি মেয়েটির উপর নির্যাতন করে। 

এমতাবস্থায় ষান্মাসিক পরীক্ষা  এসে গেল।  পরীক্ষা কী দিলাম জানি না ; কিন্তু রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল দ্বিতীয় হয়েছি।  ষান্মাসিকের খাতা ছাত্রদের দিয়ে দেওয়া নিয়ম। 

প্রথম পিরিয়ডে  বাংলা।  খাতা দিচ্ছেন ক্লাস টিচার প্রতাপ বাবু।  রোলনম্বর ডেকে সকলের খাতা দিলেন।  আমারটা  বাদ।  আশ্চর্য ! সব শেষে ডাকলেন , "ধাড়া , এদিকে আয়। " ভাবলাম , গেল রে! এবারেও নিশ্চই ডাঁহা গোল্লা ! কিন্তু এও ভাবি , তা- তো হতে পারে না , ফেল করার মত পরীক্ষা তো অন্তত বাংলায় দিই নি  .... তাহলে ! বেশ বিরক্তভাবেই গিয়ে দাঁড়ালাম। 

স্যার রেজিস্টার খাতাটার তলা থেকে আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করা একটা পরীক্ষার খাতা বার করে একটি প্রশ্নের উত্তরে আঙ্গুল দিয়ে বললেন, " এটা জোরে জোরে পড়ে  শোনা। " ভাবলাম নিশ্চই ভুল হয়েছে , এখন ক্লাসের কাছে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পড়তে বলছেন।  বললাম , " কেন , স্যার ? " বললেন , " পড়  না বাঁদর " - অগত্যা  ...

এখনো মনে আছে , প্রশ্নটা ছিল , জগদীশ চন্দ্রের " ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে'র ওপর।  'মহাচক্র প্রবাহের পটভূমিতে লেখক সৃষ্টি ও প্রলয়ের যে রূপ এঁকেছেন তা ব্যখ্যা কর। " - পড়লাম।  শেষ হলে স্যার ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন , " এটাই হচ্ছে আসল উত্তর।   তোমাদের একজন ও সঠিক লিখতে পারো নি , রণেন ছাড়া।  তোমরা সবাই নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশুল পাহাড়কে সৃষ্টি ও প্রলয়ের  প্রতীক হিসেবে ব্যখ্যা করেই থেমে গেছ ; কিন্তু মহাচক্র -প্রবাহের পটভূমিটা ব্যখ্যা করতে পারো নি। একমাত্র রণেনই করেছে।  " স্যারের কথা শুনতে শুনতে কেন জানি না , আমার দু চোখ জলে ভরে এলো।  মনে হলো এই তো যথার্থ গুরু। এক লহমায় প্রিয় ছাত্রের হেঁট মাথা আবার সকলের সামনে উঁচু করে দিলেন।  মনে মনে তাঁর পায়ে লক্ষ্য কোটি প্রণাম জানালাম।

স্যার চলে গেলে আমার খাতাটা নিয়ে টানাটানি পরে গেল।  তথাকথিত যে ছেলেদের কাছে এতদিন আমি ছিলাম ব্রাত্য , আজ হঠাৎই মহাশ্লাঘ্য হয়ে উঠলাম। আমার হীনমন্যতা এক মুহুর্তে কেটে গেল।  হারানো সিংহাসনটি যেন আবার সসম্মানে ফিরে পেলাম।

কিশোর বয়সের একটা অন্তর্লীন শুচিতা থাকে।  অনেকটা গঙ্গার জলের মতো।  আবর্জনা কখনো স্পর্শ করলেও সেই স্রোতস্বিনী শুচিতার টানে অচিরেই কোথায় ভেসে চলে যায়।

বেশিদিন নির্বাসিত থাকতে হলো না।

শ্যামসুন্দর বাবু , রুপেন বাবুদের প্রত্যক্ষ মদতে ইতিমধ্যেই স্কুলে ছাত্র ইউনিয়ন তৈরী হয়েছিল।  এ বিষয়ে সম্ভবতঃ আমাদের স্কুলই পথিকৃত। ইউনিয়নের নানা প্রয়োজনে স্যারেরাই আমাদের বিভিন্ন দক্ষতা ও নৈপুন্যগুলো কাজে লাগাতে লাগলেন।  ব্যক্তিত্বকে কুঁচকে গুটিয়ে রাখার স্বভাব বিরোধী যন্ত্রণাদায়ক লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়ে আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। 

বন্ধুরা মিলে দেয়াল পত্রিকা বের করলাম , শ্যামসুন্দর বাবু তার নাম দিলেন 'দিশারী।'  আমি হলাম তার সম্পাদক। শনিবার ছুটির পর একটি করে বিতর্ক সভার আয়োজন হলো।  আমিই তার আহ্বায়ক। আমার শুকিয়ে যাওয়া গাঙে আবার ষাঁড়াষাঁড়ি বান।  ডাকলো ; কাজের বান।  জীবনটা আবার  ছন্দে ভরে উঠলো -গতির আনন্দে।

এমনি দিনে টিফিন টাইমে একদিন 'স্যার' ডাকলেন টিচার্স রুমে।  বললেন , "বাড়িতে আসা বন্ধ করলি কেন ? " আমি আমতা আমতা করে কী যেন বলতে গেলাম ; ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে আদেশ দিলেন , " কাল থেকে আবার আসবি। ভুল যেন না হয়। "

আবার শুরু হলো সেই পুরনো রুটিন।  মনে হলো আমার কিছুই হারায় নি।  একটা বছরের সব ক্লিনতা , মালিন্য যেন এক ফুত্কারে কোথায় উড়ে গেছে।

পুজোর ছুটিতে অর্ডার হলো খাওয়া দাওয়া করে সকাল দশটায় হাজিরা দেওয়ার।  দিলাম।  ভাবলাম, দুপুরের আগেই ফিরে আসবো।  কিন্তু ফেরাটা কি আমার হাতে ! একটা-দেড়টা নাগাদ যখন ফেরার জন্য উশখুশ করছি , বললেন , "এই দুপুর রোদ্দুরে কোথায় যাবি ? বোস ; ইংরেজি গ্রামারটা বার কর। analysis গুলো দেখবো।" - অবাক হলাম।  উনি তো বাংলা - সংস্কৃতর স্যার , ইংরেজিও পড়াবেন  ... !! তিন  সেনটেন্স ও তার ভাগ গুলো জলের মত বুঝিয়ে দিলেন।  ছুটি হলো যখন , তখন চারটে  বেজে গেছে।

এইটাই রুটিন হয়ে দাঁড়ালো , দশটা থেকে চারটে , প্রতিদিন , রবিবারেও ছুটি নেই। বলাই বাহুল্য , তখন দুরদর্শন সুদুর পরাহত। বাড়িতে রেডিও-ই একমাত্র প্রমোদ-মাধ্যম।  মুষ্টিমেয় যাদের বাড়িতে গ্রামোফোন আছে , তারা তো ঈর্ষার পাত্র।  আমরা কখনই তত বড়লোক ছিলাম  না।  আর , বাইরে তখন সিনেমার যুগ।  হলে উত্তমের 'বই' এলে তো আর কথাই  নেই , ফাটাফাটি কান্ড একেবারে।

হাতিবাগানের মুখেই রাধা সিনেমা।  স্যারের বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে।  সেখানে উত্তম-অঞ্জনার 'রাজদ্রোহী' এসেছে।  বন্ধুরা  মারপিঠ করে টিকিট জোগার  করেছে। আড়াইটেয় শো।

দুটো থেকেই উঠব উঠব করছি। স্যারের মাতৃদৃষ্টিতে কিছুই লুকোনো। বললেন , " কী হলো ? কোথাও যাবি ?"
বললাম , " হ্যা , মানে প্রণবরা টিকেট কাটিয়েছে  .... "
- "টিকিট ! কিসের !"
- "ওই। .. রাধা সিনেমায়  .... রাজদ্রোহী হচ্ছে। .. "
- "রাজদ্রোহী বহুবার আসবে। কিন্তু এই বছরটাও গেলে আর ফিরবে না , এমনিতেই একটা বছর নষ্ট হয়েছে। ... বসে পড়।  অন্য সব পরে হবে '. চোখে জল এসে গেল ; না , ওঁর মহানুভবতার জন্য নয়।  বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করার এমন একটি সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট হলো বলে।  বাস্তবিক পক্ষে সেদিন ওঁর এই শুভাঙ্কর শাসনের মহত্ব বোঝার মত মানসিক প্রস্তুতি মোটেই  ছিল না ; থাকার কথাও নয়।  এত বছরের ব্যবধানে , যখন তিনি আর কোনদিন ই আমার চর্মচক্ষে ধরা দেবেন না , তখন এসব দিনের কথা ভেবে আবারও চোখে জল আসে। যদিও তা সেদিনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর কারণে।

 ভাগ্যিস , পুজোর ছুটির প্রায় শুরুতেই এই ঘটনা ঘটেছিল - লম্বা ছুটির অবকাশে বন্ধুদের মনে এ ঘটনার জ্বালা উপশম  হবার অনেকটা সময় পাওয়া গেছে ; না হলে , পর দিন ক্লাস থাকলে বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে  যেতো। 

ছুটির পর অ্যানুয়াল পরীক্ষা। দিলাম। গতবারের পরীক্ষাদর্শ বর্জন করতে বাধ্য হলাম ; এবং যথাবিধি স্ট্যান্ড ও করলাম।  তবে প্রথম নয়। দ্বিতীয় স্থান পেলাম। তবে সান্ত্বনা এই , প্রথম হয়েছিল আমাদের ফেল করা ছেলেদেরই একজন।  সম্ভবতঃ কল্যাণ।  নতুন ব্যাচের ছেলেদের দাঁত ফোটাতে দিই নি। 

ক্লাস টেনে উঠলাম।  সমস্ত বাংলা তখন উত্তাল। ছাত্র আন্দোলনের বড় বড় ঢেউ তখন আছড়ে পড়ছে কলেজ স্ট্রীটের  লোহা বাঁধা ট্রাম পথের ওপর।  শ্যামসুন্দরবাবুর নেতৃত্বে আমরাও তখন ভীষণভাবে তাতে সামিল। 'স্যার' বললেন , "শুধু ঝান্ডা নিয়ে মিটিং মিছিল করলেই মানুষের চেতনা জাগানো যাবে না। চাই শিক্ষা , ব্যপকহারে শিক্ষার বিস্তার ;  চেষ্টা কর। "ব্যস , আর যায় কোথায় !ইস্কুলের অদুরেই ছিল ছানাপট্টি বস্তি।  এখনো আছে।  এক শনিবার বিকেলে বিতর্কসভার পর বন্ধুবান্ধব নিয়ে  গেলাম বস্তি অভিযানে।  ঘরে ঘরে দরজায় দরজায় ঘুরলাম। মা-দের বললাম ,"আপনার ছেলেমেয়েদের আমাদের ইস্কুলে পাঠান, বিকেলবেলা, পাঁচটার সময়ে। " তাঁরা কিছুটা হতভম্ব।  বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায়  দুলছেন। 

প্রথম দিন পাঁচজন। এলো।  মনটা একটু হলেও দমে  গেল।  ...তবু  ঠিক আছে। ... পৃথিবীর বৃহত্তম যে পার্টি , কমুনিস্ট পার্টি , প্রথমে পাঁচ জনকে নিয়েই তৈরী হয়েছিল , স্যারদের কাছেই শোনা।  স্যারেরাই চক ডাস্টারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পাঁচ জনকে সাথী করেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো।  আমরা অর্থাৎ  শিক্ষকরা প্রায়  জনা দশেক।

অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যের খাতিরে বলতেই হবে , পরের সপ্তাহেই ছাত্র  দাঁড়ালো বিরাশিতে।  হ্যা  , আটের পিঠে দুই - বিরাশি।

মনে আছে , নিমু গোস্বামী লেন থেকে এক মা এসেছেন আধ  হাত ঘোমটা টেনে ; আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন , আমার ছেলে দুটোকে মানুষ করে দাও বাবা ; বড্ড গরীব আমরা।  মাস্টার রাখবার খ্যামতা নেই। ..." আর কিছু বলতে পারলেন না , আমার দুহাতের পিঠে টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো। আমার গলা-ও তখন বুজে এসেছে ; কোনক্রমে বললাম।  " মা গো , আমি যদি মানুষ হই , তাহলে তোমার ছেলেরাও মানুষ হবে , মা। হবেই হবে - কথা দিলাম।"

জানি না , সে ছেলেরা এখন কোথায় - কী কাজকর্ম করছে।  সে মা-ও আর আছে কিনা , তা-ও জানি না।  তবে যে আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে সেদিনের ওই ক্রন্দসী মা-কে অতবড় কথা আমি দিয়েছিলাম , বিনয়ের সঙ্গে বলছি , সে আদর্শের দীপ আমার বুকের মধ্যে আজও জ্বলজ্বল করছে এবং এই দীপের শিখাটি জ্বালিয়েছিলেন যিনি , তিনি আমার চির আরাধ্য আচার্য্যদেব , প্রতাপাদিত্য গঙ্গোপাধ্যায়।

পৌনে পাঁচটায় ছুটির ঘন্টা পড়ত ।  বেরিয়ে দেখতাম গেটের দুপাশে রকের ওপর ছোট ছোট গোলাপ চারার সারী বসিয়ে গেছে , কারোর বগলে ভাঙ্গা স্লেট , ছেঁড়া 'হাসিখুশি ' , কারুর কাঁধে সস্তা কাপড়ের ব্যাগ , কারোর বা পুঁথি পত্তরের বাহন হিসেবে বাজারের থলি সম্বল।  ছুটি হতেই তারা ওই হই করে ঢুকে পড়ত স্কুলে। একজনেরও পোশাক আশাক পাতে পড়ার যোগ্য নয়। নাকের তলায় শুকনো সর্দির দাগ ; কারো আবার কাজল পরা চোখের কোলে পিচুটি। আধ ময়লা ছেঁড়া খোঁড়া জামাপ্যান্ট। ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা কিছু কম। অমর - অনাথ-বুড়ো -হারা-খোকা-বাসু -রাজা-মেথর-কমলা-কল্যানী। ..আরও কত সব নাম। আমাদের   নবীন কৈশোর দায়িত্বশীল কাজের আনন্দে ভরে উঠলো।

ছুটির পর বাড়ি ফেরা হয় না। খিদেতে পেট জ্বলে। বুঝতে পেরে স্যারেরা চাঁদা তুলে -- কচুরি সিঙ্গারা- জিলিপি আনাতেন। প্রতিদিন। নিয়ম করে। প্রতিদিন সে এক ফিস্ট।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সোয়া ছ-টা  , সারে ছ-টা হয়ে যেত। প্রথম প্রথম বলতাম , "স্যারেরা স্পেশাল ক্লাস নিচ্ছেন" স্কুলের সদ্য প্রাক্তন আমার দাদা একদিন সব ফাঁস করে দিল।ভাবলাম,  বাবা এবার পিঠে বেত ভাঙবে। কিন্তু অবাক কান্ড। বাবার দিক থেকে সেরকম  কোনো  বিরূপ  প্রতিক্রিয়ই  দেখা গেল না। কিল খেয়ে কিল হজম করার মত তিনি তুষ্নি ভাব নিলেন। "মৌনং সম্মতি লক্ষণম "অতএব তরতরিয়ে এগিয়ে চলল আমার সমাজসেবার তরণী।

ইতিমধ্যে কৃষি বিপ্লবের ব্রত নিয়ে চাকরি ছেড়ে শ্যামসুন্দর বাবু গ্রামে চলে গেলেন। সঙ্গে গেল স্বপন মজুমদার , দীপক পাল প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র।

আমাদের বুকের গভীরে আদর্শের জোয়ার  আরও বেগবান হয়ে উঠলো। রুপেন বাবুকে গিয়ে বললাম , সামনের ১১ই সেপ্টেম্বর আমাদের ছাত্র ছাত্রী দের নিয়ে শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মোৎসর্গ দিবস উদযাপন করব। স্যার তো এক কথায় রাজী। সেদিন ওই হতদরিদ্র শিশুদের কাছে ক্ষুদিরামের আত্মোৎসর্গের ইতিবৃত্ত বোঝাতে আমাদের জিভে যেন সরস্বতী ( যদি থাকেন ) ভর করেছিল।

ইউনিয়নের প্রভাবে স্কুলে একটা  শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল। টোকাটুকি সম্পূর্ণ বন্ধ। কখনো যদি তেমন কোনো ঘটনার আভাস মেলে মাস্টারমশাইদের আর কিছু বলতে হচ্ছে মা। ছাত্র প্রতিনিধিরাই গিয়ে তাকে যথারীতি শাসিত করে আসছে।  পারস্পরিক প্রতিযোগীতা উধাও। সকলেই সকলের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিছে। এ যেন এক অপূর্ব প্রেমময় শিক্ষা  পরিবেশ।

এদিকে উত্তুঙ্গ আদর্শবোধের ছোয়াঁচ লাগা আমার তরুণ জীবন তখন আত্মগ্লানিতে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।   গ্লানির কারণ সেই পেম-পটিয়সী কিশোরী। তার প্রতি আমার আকন্ঠ আগ্রহ ততদিনে গলগ্রহে পর্যবসিত হয়েছে।  কি করে তাকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি আমার দিবারাত্রির দুশ্চিন্তা তাই।

তার সঙ্গে অমানুষিক দুর্ব্যবহার  শুরু করলাম। যতভাবে পারা যায় তাকে লোকসমক্ষে হেয় করার একটা পৈশাচিক নেশা যেন আমায় পেয়ে বসলো। অথচ বয়সোচিত প্রাকৃতিক কারণে তার সঙ্গ সুখ ও পুরোপুরি এড়াতে পারি না।  এই এক প্রচন্ড অস্বস্তিকর দোলাচলের মধ্যে জীবনটা পাঁকে পঙ্কজে অতিবাহিত হতে লাগলো। এত অসম্মাননাতেও তার দিক থেকে কোনো ভাবান্তর নেই।

এই দ্বিধাদীর্ণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার  জন্য প্রাণটা তখন আকুলি বিকুলি করছে। এক মর্মান্তিক পাপবোধে জর্জরিত হচ্ছি। এদিকে আমি যত ছাড়াতে  চাই , সে তত যেন আমাকেই জড়িয়ে ধরে , এক লালাসিক্ত মাকড়সার মতো।

আমার এই নিদারুণ  যন্ত্রণার কথা কাকে বলি ! সেই বয়সে তেমন উপযুক্ত বন্ধু কোথায় ! পুরনো বন্ধুরা তো গত বছরেই বিদায় নিয়েছে। এখন , যারা তাদের সঙ্গে পরিচয় তো সবেমাত্র এক বছর। পাড়ার বন্ধুদের বলি যে তারও উপায় নেই ; কারণ , কন্যেটি আবার আমার ই এক বন্ধুর বোন। ব্যাপারটা পাঁচ কান হলে কেলেঙ্কারী কান্ড হয়ে যাবে ; দু'. বাড়িতেই।  কিশোর বয়সের রোমান্টিক প্রেম তখন আমার গলায় ফাঁস হয়ে বসেছে।   জীভ বেরিয়ে আসার উপক্রম।  ছাড়িয়ে নেবার যত চেষ্টা করছি , তত চেপে বসছে। সে এক প্রাণান্তকর অবস্থা।

অনন্যোপায় হয়ে গুরুর শরণ নিতেই হলো। স্কুলের  শেষে এক প্রাক-সন্ধ্যার অবকাশে স্যারের কাছে গিয়ে প্রায় আত্মসমর্পণ করলাম।  সব শুনে উনি কয়েক মুহুর্তের জন্য গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর একটু গলা ঝেড়ে আমায় অমোঘ দু'তিনটি কথা বললেন।  কথাগুলি এত বছর বাদে এখনো আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়।  বললেন , " দ্যাখ , মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অন্তত দু বছর আগে মনের দিক থেকে অ্যাডাল্ট হয়ে যায়।  ওই মেয়েটি যা করছে , তা আর নিছক রোমান্স নয়। ও তোকে  গভীরভাবে  ভালোবেসে ফেলেছে।  যেমন বৌ তার স্বামীকে ভালবাসে।  এতে ওর অপরাধ কিছু নেই। এ টা ওর বয়সের ধর্ম।  ও নিজেও তা জানে ; তাই ওর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ ও নেই।  কিন্তু এতে  তোর্ ক্ষতি হবে ; কেরিয়ারের ক্ষতি।  তুই এখনো ম্যাচিওরড নোস্। তোর্ সামনে এখন লম্বা ভবিষ্যত পরে আছে। তোকে দাঁড়াতে হবে , সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হতে হবে।  ভালবাসার  যেমন সুখ আছে , তেমনি দায়িত্বও আছে। মহাদায়িত্ব।  কোনরকম দায়িত্বগ্রহণের পক্ষে তুই একেবারেই তৈরী হোস নি এখনো। আমার মনে হয় , মেয়েটিকে তুই এই সব কথা খুলে বল  ,এখনই। ও নিশ্চই সব বুঝতে পারবে। দেখবি তখন নিজেই সরে যাবে।  আর  যদি না যায় , তখন অপেক্ষা করতে বলবি।  বলবি ,নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আবার তুই ওর সঙ্গে  নতুন করে সম্পর্ক শুরু করবি।  দ্যাখ না , কী হয় - "

গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে একদিন নির্জন ছাদে , যখন আসন্ন-সন্ধ্যার গুড়ো গুড়ো  অন্ধকার আমাদের  ঘিরে  ধরেছে , তখন ওর পক্ষে ঘনিষ্ঠতম আর আমার পক্ষে দুর্বলতম মুহুর্তে ওর  কানের কাছে মুখ এনে ভাঙাচোরা গলায় ফিসফিস করে গেয়ে উঠলাম , " পৃথিবী আমারে চায়,/রেখো না বেঁধে আমায়/খুলে দাও প্রিয়া /খুলে দাও বাহুডোর ".
ও মজা পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমিও হাসলাম ; তবে কাষ্ঠহাসি। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম , " সত্যি-ই এবার আমার বিদায় নেবার পালা। এক্ষুনি যেমন হাসলে , তেমনি হাসিমুখে আমায় বিদায় দিতে হবে। "
বললে- " যাও না - কে আটকেছে ?"
বললাম , " সত্যি বলছ তো - ? এ বিদায় কিন্তু চিরবিদায়।  "
- "মানে ?"
- " ,আনে , আমাদের সম্পর্কটা এখানেই শেষ করতে চাইছি। পড়াশুনার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে "

নতমুখে অনেকক্ষণ চুপ  করে রইলো। ওই অন্ধকারেও হঠাৎ লক্ষ্য করলাম , নতমুখী পদ্মপলাশ থেকে বিন্দু  বিন্দু জল গন্ড বেয়ে চিবুকে এসে পড়ছে। আমি অবাক হবার ভান করে বললাম ," এমা  কাঁদছ ! কেন এতে কান্নার কী হলো ? এ তো সাময়িক বিরতি -"
আমরা লোকসমক্ষে তুই তুকারী করলেও আড়ালে তুমি-ই বলতাম।
ও ধরা গলায় বলল , " জানতাম এরাম কিছু হবে।  কিছুদিন ধরে তোমার ব্যবহারেই পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম।  আমাকে তোমার আর ভাল্লাগছে না।  সেটা পরিস্কার করে বললেই পারতে - এত ভনিতা করার কী দরকার ছিল ! আমি চলে যাচ্ছি।  আর কোনো দিন তোমাদের বাড়ি আসব না। " বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
এত মহা ফ্যাসাদ হলো। ... প্রথম ওষুধে কাজ হলো না। এবার তূণ থেকে ব্রহ্মাস্তটি  বার করলাম , " আরে দ্যুত ,এত সাময়িক। সাময়িক বিরতি।  বল্লাম না ! বড় হয়ে রোজগারপাতি করে তোমাকেই বিয়ে করব ? --- মাঝখানে খালি ক'টা  বছর। .... এই ক'টা  বছর আমি তোমারই থাকব।  শুধু আমাদের এই সম্পর্কটা থাকবে না। বোকা  মেয়ে কোথাকার; চোখ মোছো  , মোছো চোখ - " ও আর একটা কথাও না বলে মুখ ফিরিয়ে এক ছুটে ছাদ থেকে নেমে ওদের বাড়ি ভ্হ্কলে গেল।

সেদিন ওকে  যে কথা দিয়েছিলাম , তখনই জানি , সে কথা আমি কোনদিনই রাখতে পারব না , বা বলা যেতে পারে , রাখব না। কারণ , তার অনেক আগেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে , বিয়ে থা করে, নেরিগেন্দী বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে, রেশন -বাজার করে ধম্ম আমার পোষাবে না।  আমি কবিতা বলব , নাটক করব , দেশের কাজ করব। ....... রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটি মনে মনে খুব আওড়াতুম , " বিশ্বজগত আমারে মাগিলে , কে মোর আত্মপর ! / আমার দেবতা আমাতে জাগিলে কোথায় আমার ঘর !"

পরে ওই বিরহিনীর বিয়ে হয়ে যায় আমাদেরই দূরসম্পর্কীয় এক  যুবকের সাথে।  আরও পরে , আমার শিষ্য -শিষ্যা মন্ডলী অন্তর্গতা তারই এক রুপসী কনিষ্ঠা " বয়সকালে আমার কী দুর্দশা হবে , কে দেখবে আমাকে " এই দুর্ভাবনার বশবর্তী হয়ে প্রেম নিবেদন করতে এলে , তাকেও রবীন্দ্রনাথ শুনিয়ে বিদায় দিয়েছিলাম , " মোর তরে করিও না শোক / আমার রয়েছে কর্ম , আমার রয়েছে বিশ্বলোক। "

কিন্তু সে আলোচনার ক্ষেত্র অন্যত্র।
 
  
 
 
 
(অন্তিম পর্ব আগামী শুক্রবার )

 

11 comments:

  1. Asamanya. Sachetan r abochetan sab mile mise ekakar....

    ReplyDelete
  2. Subhashish MukherjeeJanuary 17, 2015 at 5:19 PM

    This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  4. Subhashish MukherjeeJanuary 17, 2015 at 5:21 PM








    ager parbo pode je agroho tairi hoechilo,e parbo tar thekeo anek besi kichu diye gyalo.nirbhoy atmo bislesan,nirvik atmokathon,nirabaron guru vakti....sab kichur mishel e ek govir gatha hoye utheche ei satyanucharon.jar kendrabindu te roechen ek disahin shishyo o bindu te royechen ek nirlipto, udarmonosko,snehamoy,drihacheta shikhak tatha guru.je guru tar shishya k sarbo pather disha dichen r muhurtora itihas hoye choleche eker par ek.jagotik prem r manobik prem r dwirath er maajhe gode uthche charitro,jar vitsthapon hoche ek atmogyani gurur haat dhore.atmouttoron hoche ek kishorer.chintar prosarone here jache samaj,jite jache chetona,jite jache manushhotto, nirdwidhay jiban r satyo k beche nichen shishyo.....gurur chayay.e lekha pode valo lagche ei vebe je kon adhare lukie thake alo,take janabar jonyo jathestho bolistho vasha royeche lekhk r haate aar kharap lagche ei vebe j ei jug, ei valobasa,ei nirvik atmobislesoner govir anweshon r din aaj r nei kothao.chatrochatrira ekhon prokasye chumu khye samarthon janay goponiyotake,prokashye aslil vasha bole njk update kore,prem k nagnotay niye giye biratto vebe gorbito hoy,abokhoy k vabe culture,sanskriti k vabe binodon aar njk vabe jantro.j jantro mastiskohin, hridayhin ek haat pa wala sarir....jar sab ache, sudhu snigdho kono mmon nei,sachcho kono vabna nei,veshe jawar mato kono pabitro hriday nei aar haat dhore path dyakhanor kono guru nei.anobadyo ei lekhan njk aro ekbar njr saamne daar koriye dilo,natun kore valobaste shekhalo jibaner amulyo dhan k,jar naam guru,bandhu,debata.jayguru....

    November 21, 2014 at 2:51pm · Edited · Unlike · 4

    ReplyDelete
    Replies
    1. voy chhilo , je samporko ekantoi bektigoto , sadharonyo hole ta jogyo kodor pabe kina ... apnar anabil anuvab amar akopot atmokothon ke marjadariddho korechhe .ki bolbo - dhonyobad ! naki sakritagnyo ovinondon ! tabe etuku boltei hobe nijeke mele dhorte notun kore onupranito hoam @ Subhashish Mukherjee

      December 3, 2014 at 11:09pm · Edited · Unlike · 2

      Delete
  5. ekti Manush tokhon e ei vabe atmo bishleson korte paren, jokhon tar vitor akti nirvik manob satwa proshroy pay.. ebong ei bishesh choritro ti gorar mul kandari sei mohan Guru, jini kina akadhare bondhu, potho prodorshok abong Dev sorup..protiti manush er jibon ei emon akjon Guru thaka atynto joruri bole mone hoy..kintu akhonkar ei ati jantrik jug e ei "Guru-Sishyo" porompora luptopray..er jonno sudhu Sishyo kul ke dosh deao jay na, karon Guru rai akhon anek besi professional (totha kothito)..

    Tai e juger ba ei projonmer ekti manush hoeo eta mone kri, Srodhyeo Dhara Babur ei akhyan ti ajker projonmer kache "Guru-Sishyo" porompora er Gun, (Ja manush er choritro gorte ebong Jantrik manosikotar hat theke rokkha pete sohayota kore) ke sobishesh vabe tule dhoreche, jar kendro bindu tir naam Shri Pratapaditya Gangopadhyay..

    November 22, 2014 at 12:46pm · Edited · Unlike · 4

    ReplyDelete
  6. Eto serious ekta write up FB te eto somorthon pabe .. tao abar dharabahik obotarona .. vabte pari ni. E lekha amake je koto kichhu diechhe , taa shudhu ami i jani . E amar ekanto priyo dui bektir upakhayn .. ja ami shudhu sarbo samokkhe ante cheyechhilam. Kintu amar ei proyas je eto ta sara pabe .. kolponateo chhilo na . Sokol er somorthone ami ovivuto , apluto , onupranito. Amake sahos joganor jonyo sakol ke antorik dhonyobaad . Atashi Chatterjee , Subhashish Mukherjee , Krishanu Pal , Mitu Malakar , Supriyo Sarkar , Ritu Chakraborty , Puranjit Gangopadhyay ebong alokkhe thaka r o aneke .

    ReplyDelete
  7. Erm 1ta valo upohar amader deoar jnno dhonyobad ta tomar prapyo. Anek kichu janlam sikhlam tomar lekha theke. R sbcheye boro ktha holo ei hitech juge fast n busy life er mdhyeo time ber kore technologyr ato sundor use kore amader anek kichu sikhiye dile tumi.

    December 4, 2014 at 9:03pm · Unlike · 2

    ReplyDelete
  8. Dhonyobaad Janai aro akbar Dhara Babu ebong Durba Didi ke, ei asadharon akhyan ti share korar jonno..bhobishyote erokom aro kichu akhyan porar asha rakhlam..apekhyay thaklam.. Valo thakben sobai..

    December 4, 2014 at 9:51pm · Unlike · 1

    ReplyDelete
  9. Subhashish MukherjeeJanuary 17, 2015 at 5:28 PM

    asol dhonyobaad jar prapyo,ekmatro sei manush ti e eholok e nei, take dhonyobaad bala jayna....pronaam jananor iche hoy...sahos o tini e jugiechen....tabe e lakha eto tadatadi ses howar noy....antare aro parbo nivrite tairi hoe jay ajante...tabu lekhaker mukhe aro sunte iche hoy...baki jibaner katha...r durba njr charom byastotar majheo ei lekha r jonyo jathestho porisrom koreche, sabar saamne eke anar prochestay....take sadhubaad janai......

    December 4, 2014 at 10:24pm · Like · 1

    ReplyDelete
  10. Eto sundor onubhuti jeno chokher samne jol jol korche.aro lekha chai.ami boi porua noi.kintu ei lekha porata amar nesha hoy darachche.

    December 5, 2014 at 8:31pm · Unlike ·

    ReplyDelete