গুরবে নমঃ
(অন্তিম পর্ব )
- রণেন্দ্রনাথ ধাড়া
এর পরেই কয়েক দিনের জন্য মা-বাবার সঙ্গে দেশভ্রমণে বেরোলাম। প্রথমেই ভূ-স্বর্গ। কাশ্মীরের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে , শীতার্ত পরিবেশে বিক্ষিপ্ত মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। সজ্জিত শিকারায় বসে মোঘল গার্ডেন্স দেখতে দেখতে পুরনো জ্বালা অনেকটাই উপশম হলো। কাশ্মীর থেকে হরিদ্বার , সেও বড় রমণীয় যাত্রা। খরস্রোতা হর কে প্যারী'র তীরে বসে ওপারের ধুসর বালুচর দেখতে দেখতে মনটা উদাস হয়ে যেত। বোধ হয় কিছুটা উদার ও ; কেন না , কখন যেন ভেতরে ভেতরে আমার আদর্শপথে কাঁটা ছড়ানো বিপ্রলব্ধা বালিকাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম।
ফিরে এলাম একটা ঝর ঝরে তাজা শান্ত মন নিয়ে। সামনেই হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা। স্যারের তত্ত্বাবধানে কোমর বেঁধে লেগে গেলাম তার প্রস্তুতিতে। দেখলাম , এতদিনের বে-হাজিরায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। রাত্রি জেগে গল্পের বই পড়ার অভ্যেস ছিল , পড়ার বই পড়ি নি কখনো , মনে হলো এবার তাও করতে হবে। তবে না ; অতদূর যেতে হয় নি , রাত্রি এগারো সারে এগারোটা অব্দি পড়েই অনেকটা মেক আপ দিতে পেড়েছিলাম। তার প্রমাণ রেজাল্টেই মিললো। জীবনে সম্ভবতঃ প্রথম ,পরীক্ষায় প্রথম হলাম।
স্যার খুশি হলেও তেমন ভাবে কখনো প্রকাশ করতেন না ; তাঁর প্রকাশের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদিন বললেন , এবার তোকে নিজে লেখালিখি করতে হবে ; সংস্কৃতে।
আমার মাথায় বজ্রাঘাত। আমি লিখব ! তাও আবার সংস্কৃতে ! কী লিখব !
স্যার বললেন , "কেন ? গল্প , কবিতা , প্রবন্ধ , যা পারিস। ...মোট কথা তোকে ক্রিয়েটিভ লেখা লিখতে হবে। "
আমি বললাম , " অসম্ভব , আমি বলে এখনো টেন্স -ই ঠিক করতে পারি না। বিশেষ করে অতীত কালের ধাতুরূপ গুলো হামেশাই গুলিয়ে ফেলি .... 'লঙ ' করতে গিয়ে 'লোট ' হয়ে যায়। 'লোট ' করতে গিয়ে 'লঙ '.. আমি লিখব গল্প ! অসম্ভব। "
স্যার বললেন , "তোকে লিখতেই হবে। যা মনে আসে লিখবি। অতীত কালের রূপ লিখতে যদি গন্ডগোল হয় , বর্তমানের রূপ লিখে তার সাথে স্ম যোগ করে দিবি। যেমন , যদি 'অকরত ' মনে না আসে 'করোতি স্ম ' লিখবি। তাতেই হবে। "
শুরু করলাম। প্রতিদিন হাবি জাবি যা মনে আসত লিখে স্যারকে দেখাতাম। তিনি কারেকশন করে দিতেন। বুঝতে পারি নি তাঁর ছত্র ছায়ায় নিম ডালগুলো নিমচন্দনে পরিণত হচ্ছে।
একদিন একটা ভাগবত গীতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন , " ভালো করে পড়বি । বাংলা টীকা গুলো দেখবি না। নিজে থেকে বোঝার চেষ্টা করবি। একমাত্র আটকে গেলে শুধু শব্দের মানেটা দেখে নিবি , টানা মানে নয়। "
পড়লাম। এক দস্তুর মত খটমট অভিজ্ঞতা। যখন ফেরত দিতে গেলাম , জিগ্গেস করলেন বুঝতে পারলি ?" বললাম , " এতে আর বোঝার কী আছে ?এ তো ধর্ম পুস্তক। "বললেন , " শুধু ধর্মটাই দেখলি ? এর সাহিত্যটা দেখলি না ! দর্শনটা দেখলি না !"বললাম , " ভীষণ অদৃষ্টবাদী দর্শন। প্রতিক্রিয়াশীল। মানুষের শুধু কাজেরই অধিকার , ফলের নয় ! ফলের আশা না থাকলে মানুষ কাজ করবে কেন ? কিসের আশায় ?"
- " আশা না মিটলেই হতাশা আসে। হতাশা খুব সাংঘাতিক জিনিস। মানুষকে জীবন্মৃত করে ফেলে। গেল বছরের কথা মনে নেই ? ফেল করার পর তোর্ মনের কী অবস্থা হয়েছিল ? ভুলে গেছিস ? আসলে কী জানিস তো , বছর বছর পাশ করার ফলে তোর্ পাশ করার আশাটা পুষ্ট হয়ে গেছিল। তাই , যেই একবার ফেল করলি , অমনি সেই এক টোকাতে তোর্ আশাগাছের সব স্বর্ণমন্জরি ঝরে পড়ে গেলো। তুই "নীরস তরুবর " হয়ে গেলি। তুই যদি মনে করতিস , 'ভালো পরীক্ষা দেওয়াটাই আমার কাজ , পাশ - ফেল করানোর দায়িত্ব পরীক্ষকের ' - তাহলে দেখতিস তোর্ এতটা হতাশা আসত না। অবশ্য ব্যপারটা অত সহজ নয়। "
- " আমার মনে হয় কাম্যও নয়। ফলের আশা না থাকলে মানুষের কাজে উদ্যোগ থাকবে কেন ? সে তো উদ্যামহীন হয়ে পড়বে। এবং কাজ করলেও সেটা তার পক্ষে নিতান্তই ইচ্ছা-নিরপেক্ষ যান্ত্রিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে। আর তাছাড়া এভাবে ভাবতে গেলে একজন সর্বশক্তিমান অদৃশ্য কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিতে হয় , যা একান্তভাবেই মানুষের দায়িত্বশীল কর্মপ্রতিভার উপর অনাস্থা প্রদর্শন। "
সত্যি কথা বলতে কি রাজনৈতিক শিক্ষা না পেলে স্যারের মুখে মুখে এভাবে তর্ক করার শক্তি বা সাহস কোনটাই পেতাম না। আর আমাদের পরম ভাগ্য যে , স্যারেরা এটাকে কোনদিনই 'ঔদ্ধত্য ' মনে করেন নি। বরং আমাদের যুক্তিশিলোতে উত্সাহ দিয়েছেন।
বললেন , "রবীন্দ্রনাথের একটা আছে , ' আমি বহু সাধনায় প্রানপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে / এ কৃপাকঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভরে। " এখন বুঝবি না , আরও বড় হ' তখন এর মর্ম বুঝতে পারবি। যাই হোক , গীতার তাহলে কোনো অংশটাই তোর্ ভাল্লাগেনি ! " বললাম , " ওই একাদশ অধ্যায়ে বিশ্বরূপ দর্শনের অংশটুকু বেশ উন্নত সাহিত্য রস সমৃদ্ধ বলে মনে হলো। "
বললেন , " তবু ভালো ; ঠিক আছে ওই অংশটুকু ভালো করে মুখস্ত করে এসে আমাকে আবৃত্তি করে শোনাবি। যা। সময় কিন্তু এক সপ্তাহ। "
এক সপ্তাও লাগলো না। পাঁচ দিনেই মুখস্ত করে ফেললাম। কিন্তু আবৃত্তি করতে গেলে তো উচ্চারণগুলো সঠিক হওয়া চাই। পারব না তা নয়। .. তবু , ঠিক কনফিডেন্স পাচ্ছি না। স্যারকে গিয়ে বললাম। বললেন , " বল , শুনি। " শোনালাম। কয়েকটি উচ্চারণ ঠিক করে দিলেন। বিশেষ করে ব-ফলা য় -ফলা উচ্চারণের তফাতটা। বললেন , "অবাঙালিরা তবু কিছুটা ঠিক ঠাক বলে। ; বাঙালিরা রসনায় সব একাকার। "
তারপর ওঁর সংগ্রহ থেকে আর একটি বই দিয়ে বললেন , " এবার এটা পড় ; যেখানটা ভালো লাগবে মুখস্ত করবি। " দেখলাম , " মেঘদুতম কালিদাসস্য। "
বাড়ি এসে পড়া শুরু করলাম। সত্যি বলতে কি , সব কথা যে বুঝতে পারছি - তা নয় ; কিন্তু , একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে পড়ে চলেছি। যক্ষের বিরহ যেন আমার সমস্ত মন প্রাণ ছেয়ে একটা ঘনঘোর বর্ষা দিনের মত ঘিরে ধরল। আলাদা করে কোনো অংশটুকু মুখস্ত করবো !
প্রথম থেকেই শুরু করলাম " কস্চিত কান্তা বিরাহগুরুণা স্বাধিকার প্রমত্তঃ ,/ শাপেন্স্তং গমিত মহিমা বর্ষাভোগ্যেণ ভর্তুহ / যক্ষশ্চক্রে জনকতনয়া স্নানপুণ্যদকেষু / স্নিগ্ধচ্ছায়া তরুষু বসতিং রামগির্যা শ্রমেষু। " নির্জন গ্রাম্য পথে 'ক্যাচোর -কোচর 'করে গরুর গাড়ি চলার ঢিমে লয়ের মন্দাক্রান্তা ছন্দ যেন রামগিরি আশ্রমে বন্দী যক্ষের মন্দগতি জীবযাত্রার প্রতীক হয়ে দেখা দিল। এক অনাস্বাদিতপূর্ব আবেশ আমার সমস্ত সত্ত্বাকে মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মতো আবিষ্ট করে রাখলো। এই প্রথম বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার বই পড়ে আমি অমন আত্মহারা হয়ে রইলাম।
এইভাবে দিনের পর দিন তিনি তাঁর সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে , শুভ কামনার মঙ্গলদীপ জ্বেলে তাঁর প্রিয় ছাত্রটিকে নির্মাণ করে তুললেন। পিতৃস্নেহ এর অধিক কী হতে পারে আমার জানা নেই। নিজের হাতে একটা একটা পাপড়ি খুলে খুলে একটা পদ্মকোরককে প্রস্ফুটিত শতদল বানাতে চাইলেন। তাঁর সেই আন্তরিক প্রয়াস সফল হয়েছে কিনা , তা আমি বলতে পারব না।
কিন্তু একটা ব্যাপারে তাঁর সাফল্যের সার্থকতা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ; তা হলো। যে আমি সংস্কৃতে একশ'র মধ্যে পনের পেয়ে তাঁরই ডেস্কের ওপর খাতা কুচিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম , সেই আমার মধ্যে তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের এমন আকন্ঠ তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছিলেন যে , হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পর যখন কার্যতঃ সংস্কৃতলোক থেকে নির্বাসিত হলাম , তখন হেরোইনের নেশা মতো একটু সংস্কৃত পড়ার জন্য ঘুরে বেরিয়েছি এর দুয়ারে , তার দুয়ারে।
শেষে আমার দাদার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে গেলেন বৈঠকখানা রোডে এক পন্ডিতের বাড়ি। তিনি আমাকে আদ্য মধ্য পরীক্ষাগুলো দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। তাঁর দয়ায় আবার পড়তে শুরু করলাম অমরকোষ , ,মিত্রলাভ লঘু-কৌমুদী ইত্যাদি। কিন্তু সে প্রসঙ্গ বারান্তরে। একটি একেবারেই অপছন্দের বিষয়ের প্রতি বিশ্বগ্রাসী ভালবাসা জাগিয়ে তুলেছিলেন যে দেবপ্রতিম ঐন্দ্রজালিক , তিনি এক আশ্চর্য শিক্ষক প্রতাপাদিত্য গঙ্গোপাধ্যায়।
তাঁর কথা শতমুখে বললেও শেষ হবার নয়।
পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। বাংলায় অনার্স নিলাম। সে এক মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মত ওড়ার কলি। তখন সাতের দশকের শুরু। সমস্ত দেশ যেন এক নতুন সমাজ জন্ম দেবার প্রসব করার যন্ত্রনায় ছটফট করছে। গ্রামে - গ্রামে কৃষিবিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে। শহরে এসে পড়ছে তারই অভিঘাত। আমাদের ছাত্র জীবন আরো টালমাটাল।
ইউনিয়নের দাদারা এসে বলল , "তোমায় সি.আর. হতে হবে। "অর্থাৎ ক্লাস রিপ্রেসেনটেটিভ। বললাম , "ঠিক আছে , ভেবে বলব। " ওরা বলল , " ভাবাভাবির সময় নেই। কালই ফর্ম ফিলাপের শেষ দিন। "
শাসক দলের ইউনিয়ন, 'না' বলতেও পারছি না, অথচ ইচ্ছেও নেই এক ফোঁটা। চিন্তার কিছু নেই। আমার গুরু তো আছেন । এলাম তাঁর কাছে। তখন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। স্যারের কাছে গিয়ে সমস্ত ইতিবৃত্ত পেশ করলাম। একটুক্ষণ ভাবলেন ; তারপর বললেন , "এক কাজ কর। ইলেকশন না হওয়া পর্যন্ত কলেজ যাওয়া বন্ধ কর। পরে গিয়ে বলবি , অসুখ করেছিল। ওরা অত মেডিকেল সার্টিফিকেট -টিকেট দেখতে চাইবে না। "
প্রণাম করে চলে এলাম। এবং যথা নির্দেশ কাজ করলাম। এবং ইছাবিরোধী কাজ করার এক অনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেলাম।
এইভাবে বারবার , বারবার তিনি আমাকে উদ্ধার করেছেন সমূহ বিপদের সর্বনাশা আশঙ্কা থেকে। মা যেমন করে দুহাতে সন্তানকে আগলে রাখে , ঠিক তেমনি করে।
তারপর , ধীরে ধীরে স্বাভাবিক নিয়মেই দৈনন্দিন যোগাযোগ কমে এলো। সময় পেলেই ওঁর বাড়ি যেতাম। নতুন কলেজ জীবনের প্রগাঢ় মাদকতায় আমিও মত্ত হলাম। উনিও সংসার জীবনে প্রবেশ করলেন। বিচ্ছেদ দীর্ঘতর হতে শুরু করলো।
কিন্তু চাঁদ আর সাগরে তো অনন্ত বিচ্ছিন্নতা ; তবু পূর্নিমা অমাবস্যায় চাঁদের টানে সাগরের বুকে ভরা -কোটাল আসে কী করে ! এ রহস্য এক অপার রহস্য ; বোধ হয় কখনো তা মেটার নয়।
তার প্রমাণ ?
স্কুল জীবন শেষ হয়েছে প্রায় পনের বছর হয়ে গেল। ছাত্র জীবনই শেষ।
প্রচুর টুইশানি করছি।
বালক ভাইপো এসে বলল , " তোমাকে একটা ছেলে ডাকছে। "
নীচে গেলাম , দেখলাম এক কিশোর।
- "কী ব্যপার , আমায় কিছু বলবে ?"
-হ্যা , প্রতাপবাবু স্যার এই চিঠিটা পাঠিয়েছেন।" নিয়ে পড়লাম , "আজ বিকেলে একবার স্কুলে আসবি ?"
বললাম , "স্যারকে বোলো , আমি যাব। "
গেলাম। "কী ব্যপার স্যার , হঠাৎ তলব ?"
-"বোস। .... কী হলো ? অত চিন্তার কিছু নেই। হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে হলো। অনেকদিন দেখা হয় নি তো - চা খাবি ?"
কে যেন সপাটে গালে চড় কষালো। " তুই মানুষ ! দ্যাখ মানুষ কাকে বলে , ভালবাসা কাকে বলে -"
আমার গলা বুজে আসছে। গলা ঝেড়ে বললাম , "খাব স্যার। আওনি খাওয়ালে 'না' বলতে পারি ! তারপর কত কথা হলো। সুখ দুঃখের কত কথা ! চলে এলাম যখন , মনে হলো গঙ্গাস্নান করে এলাম।
অনেক কাল আগে সুসাহিত্যিক মনোজ বসুর "মানুষ গড়ার কারিগর " নামক একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। সেটিও একটি মাস্টারমশাই-এর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কাহিনী। গল্পটা এখন আর মনে নেই ; কিন্তু ওই গ্রন্থ নামটি কোনদিন ভুলবো না। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ওই "মানুষ গড়ার কারিগর " শব্দচয়নটি অবিস্মরণীয়। আমার 'স্যার ' ছিলেন তারই উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
আরও কয়েক বছর পরের ঘটনা। বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হচ্ছে। ইচ্ছে না থাকলেও তাই নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। হঠাৎ সদর দরজায় করা নাড়ার শব্দ। নিজেই গিয়ে দরজা খুলি। স্যার দাঁড়িয়ে।
- " আসুন , আসুন। হঠাৎ , কী ব্যপার স্যার ? "
-তুই তো ভুলে গেছিস ; আমার তো তোকে এখতে ইচ্ছে হতে পারে - " মরমে মরে গেলাম , নাকি শরমে !
মনে পড়ল , তখন ইলেভেনে পড়ি। এমনি এক সন্ধ্যায় পাড়ার একটি ছেলে এসে বলল , "পুলুদা , এক ভদ্দরলোক তোমায় খুঁজছে। সেদিনও তাড়াতাড়ি নেমে এসে দেখেছিলাম স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে গিয়ে জিগ্গেস করলাম , "আসুন স্যার , বাড়ি চিনলেন কী করে ?" বললেন , " এই ছেলেটিকে জিগ্গেস করে। চল , তোর্ মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলব। "
মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম। বললেন , "রণেন সন্ধ্যে বেলায় কখন পড়তে বসে ? "
মা বললেন ওর কোনো ঠিক নেই। কখনো সাতটা কখনো সাড়ে সাতটা "
বললেন , "ওকে আমি বলে যাচ্ছি , প্রতিদিন ছটা থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে পড়তে বসবে। সামনে টেস্ট পরীক্ষা। না- হলে allowed হবে না। আমি মাঝে মধ্যে আপনার কাছে এসে খবর নিয়ে যাব। "
মা অভিভূত। বললেন , " আপনারাই ওকে মানুষ করে দেবেন। আমাদের আর কিছু করতে হবে না। আশির্বাদ করুন , ও যেন জীবনে এ ঋণ কখনও না ভোলে। বসুন। চা খান। "
তারপর সত্যিই প্রায়মধ্যেই চলে আসতেন। মায়ের কাছে খোঁজ খবর নিতেন ; এক কাপ চা খেয়ে চলে যেতেন। বৈষ্ণবশাস্ত্রে "অহৈতুকী কৃপা " বলে একটা কথা আছে। জানি না , কোন ভাগ্যে , আমি স্যারের এই "অহৈতুকী কৃপা " লাভ করতে পেরেছিলাম।
আজ তিনি দেখাশোনার বাইরে চলে গিয়েছেন। আমার এই স্মৃতিবন্দনা তাঁকে ছোঁয়ার কথা নয়। কিন্তু কেমন যেন মনে হয় , আমার এ তর্পণ তাঁর চরণ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ধূপ পুড়ে যায়। কিন্তু তার গন্ধটুকু ভাসতে থাকে বাতাসে। তিনি চলে গিয়েহ্ছেন। কিন্তু তাঁর অদৃশ্য অস্ত্বিত্বের "ওম " টুকু আমাকে ঘিরে আছে। থাকবে। হয়ত সারা জীবন জুড়ে।
আপনি আমায় শিখিয়েছিলেন একটি অনবদ্য শব্দ , "বসুধৈব কুটুম্বকম। " সেটি আপনার জীবনে আর শব্দমাত্র থাকে নি , হয়েছিল এক সত্যঋদ্ধ জীবনদর্শন। আপনাকে দেখে শিখেছিলাম সমগ্র বসুধাকে কেমন করে কুটুম্ব বানিয়ে তুলতে হয়। শিখেছি। কিন্তু আপনার মত প্রয়োগ করতে পারি নি। আধার সবার এক মাপের হয় না , আপনার বুকের আধারে একটা আকাশ ধরে যেত। অত বড় আধার আমি কোথায় পাবো ! তবু বাকি জীবনটা চেষ্টা করে যাব আমার ছাত্র-ছাত্রী ও কনিষ্ঠদের কাছে আর একটা প্রতাপবাবুস্যার হয়ে উঠতে।
আপনি শুধু আশির্বাদ করুন , সব কালের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের জীবনে একটা যেন প্রতাপবাবু পায়। না হলে তাদের ছাত্রজীবন ব্যর্থ বিস্বাদ হয়ে যাবে।
আর কে বলতে পারে , তাদের মধ্যে থেকে কেউ রণেন্দ্রনাথ না হয়ে নরেন্দ্রনাথ হয়ে উঠবে না !
সমাপ্ত
-----------
No comments:
Post a Comment