Tuesday, December 23, 2014

ANONDI
      
kol peteche sabuj durba ghaas
mathar opor akash anirban
ki ba r debar ache tomay
dur probaaser bristiveja gaan

jekhane ja anondo ashim
tomar sange karuk sandhi
tumi sabar anondo rimjhim
amar valobasar ANONDI           



annaprasoner ador............
 

Sunday, November 30, 2014

শব্দহীন এক নিরন্তর গতি
ছুটছে ছুটছে ছুটছে
তাল মেলাতে মেলাতে
ছুটছে পৃথিবী
এক অন্তহীনতার পথে।
আছড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ
ঠুকরে ঠুকরে ভাঙ্গছে পাথর
বোবা কান্নায় ভরছে বাতাস
দিগ্বিদিকে শুধু পোড়া পোড়া  গন্ধ।
কী  পুড়ছে ?
ও কী  পুড়ছে ?
পুড়ছে সভ্যতা
অবক্ষয়ের আঁচে পুড়তে পুড়তে
ঝলসে যাচ্ছে যৌবন।
সেই ঝলসানো তাতে ক্ষইছে ভিতর
ক্ষইছে ভিতরে লুকিয়ে থাকা বোধ
মূল্যবোধের প্রাচীর নুইতে নুইতে
লুটিয়ে যাচ্ছে লোভের পদপ্রান্তে
ঈর্ষা , কাম , ক্রোধ ভরে দিচ্ছে  হৃদয়
জায়গা নিচ্ছে উন্মত্ততা
মানবিকতার বলিতে চড়ানো হচ্ছে
মাৎস্যন্যায়ের ভেট
পতন পতন পতন
অবাধ পতন
আগ্রাসনের লকলকে জিভ
হুসহাস করে টেনে নিচ্ছে সবটুকু জীবন।
জীবন বেঁচে থাকে -টানে , মানে , প্রাণে
সব ডুবে যাচ্ছে
ডুবে যাচ্ছে সব অলসতার অতলে
মুখ থুবরে পড়ছে
ভাবনাহীন , চিন্তাহীন ভালোবাসাহীন পৃথিবী
ইতিহাস সাক্ষী রেখে পৃথিবীর এই নিঃশব্দ ক্ষয়
ষড় রিপুর দামামা বাজিয়ে
এখন শুধু কলিকালের জয়
জয় , কলিকালের জয়।


 

Friday, November 28, 2014

 
 

গুরবে নমঃ 

(অন্তিম পর্ব )

                                                         - রণেন্দ্রনাথ ধাড়া 



এর পরেই কয়েক দিনের জন্য মা-বাবার সঙ্গে দেশভ্রমণে বেরোলাম।  প্রথমেই ভূ-স্বর্গ।  কাশ্মীরের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে , শীতার্ত পরিবেশে বিক্ষিপ্ত মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো।  সজ্জিত শিকারায় বসে মোঘল গার্ডেন্স দেখতে দেখতে পুরনো জ্বালা অনেকটাই উপশম হলো।  কাশ্মীর থেকে হরিদ্বার , সেও বড় রমণীয়  যাত্রা।  খরস্রোতা হর কে প্যারী'র তীরে বসে ওপারের ধুসর বালুচর দেখতে দেখতে মনটা উদাস হয়ে যেত।  বোধ হয় কিছুটা উদার ও ; কেন না , কখন যেন ভেতরে ভেতরে আমার আদর্শপথে কাঁটা ছড়ানো বিপ্রলব্ধা বালিকাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম।

ফিরে এলাম একটা ঝর ঝরে তাজা শান্ত মন নিয়ে।  সামনেই হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা।  স্যারের তত্ত্বাবধানে কোমর  বেঁধে লেগে গেলাম  তার প্রস্তুতিতে।  দেখলাম , এতদিনের বে-হাজিরায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি।  রাত্রি জেগে গল্পের বই পড়ার  অভ্যেস ছিল , পড়ার বই পড়ি নি কখনো , মনে হলো  এবার তাও  করতে হবে।  তবে না ; অতদূর যেতে হয় নি , রাত্রি এগারো সারে এগারোটা অব্দি পড়েই অনেকটা মেক আপ দিতে পেড়েছিলাম। তার প্রমাণ রেজাল্টেই মিললো। জীবনে সম্ভবতঃ প্রথম ,পরীক্ষায় প্রথম হলাম।

স্যার খুশি হলেও তেমন ভাবে কখনো প্রকাশ করতেন না ; তাঁর প্রকাশের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।  একদিন বললেন , এবার তোকে নিজে লেখালিখি করতে হবে ; সংস্কৃতে।

আমার মাথায় বজ্রাঘাত।  আমি লিখব ! তাও আবার সংস্কৃতে ! কী লিখব !

স্যার বললেন , "কেন ? গল্প , কবিতা , প্রবন্ধ , যা পারিস। ...মোট কথা তোকে ক্রিয়েটিভ লেখা লিখতে হবে। "

আমি বললাম , " অসম্ভব , আমি বলে এখনো টেন্স -ই ঠিক করতে পারি না।  বিশেষ করে অতীত কালের ধাতুরূপ গুলো হামেশাই গুলিয়ে ফেলি   .... 'লঙ ' করতে গিয়ে 'লোট ' হয়ে যায়।  'লোট ' করতে গিয়ে 'লঙ '.. আমি লিখব গল্প ! অসম্ভব। "

স্যার বললেন , "তোকে লিখতেই হবে।  যা মনে আসে লিখবি।  অতীত কালের রূপ লিখতে যদি গন্ডগোল হয় , বর্তমানের রূপ লিখে তার সাথে স্ম যোগ করে দিবি। যেমন , যদি 'অকরত ' মনে না আসে 'করোতি স্ম ' লিখবি।  তাতেই হবে। "

শুরু করলাম।  প্রতিদিন হাবি জাবি যা মনে আসত লিখে স্যারকে দেখাতাম।  তিনি কারেকশন করে দিতেন।  বুঝতে পারি নি তাঁর ছত্র ছায়ায় নিম ডালগুলো নিমচন্দনে পরিণত হচ্ছে।

একদিন একটা ভাগবত গীতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন , " ভালো করে পড়বি ।  বাংলা টীকা গুলো দেখবি না।  নিজে থেকে বোঝার চেষ্টা করবি। একমাত্র আটকে গেলে শুধু শব্দের মানেটা দেখে নিবি ,  টানা মানে নয়। "

পড়লাম।  এক দস্তুর মত খটমট অভিজ্ঞতা। যখন ফেরত দিতে গেলাম , জিগ্গেস করলেন  বুঝতে পারলি ?" বললাম , " এতে আর বোঝার কী আছে ?এ তো ধর্ম পুস্তক। "বললেন , " শুধু ধর্মটাই দেখলি ? এর সাহিত্যটা দেখলি না ! দর্শনটা দেখলি না !"বললাম , " ভীষণ অদৃষ্টবাদী দর্শন। প্রতিক্রিয়াশীল। মানুষের শুধু কাজেরই অধিকার , ফলের নয় ! ফলের আশা না থাকলে মানুষ কাজ করবে কেন ? কিসের আশায় ?"
- " আশা না মিটলেই হতাশা আসে।  হতাশা খুব সাংঘাতিক জিনিস।  মানুষকে জীবন্মৃত করে ফেলে। গেল বছরের কথা মনে নেই ? ফেল করার পর তোর্ মনের কী অবস্থা হয়েছিল ? ভুলে গেছিস ? আসলে কী জানিস তো , বছর বছর পাশ করার ফলে তোর্  পাশ করার আশাটা পুষ্ট হয়ে গেছিল। তাই , যেই একবার ফেল করলি , অমনি সেই এক টোকাতে তোর্ আশাগাছের সব স্বর্ণমন্জরি ঝরে পড়ে গেলো। তুই "নীরস তরুবর " হয়ে গেলি।  তুই যদি মনে করতিস , 'ভালো পরীক্ষা দেওয়াটাই আমার কাজ , পাশ - ফেল করানোর দায়িত্ব পরীক্ষকের ' - তাহলে দেখতিস তোর্ এতটা হতাশা আসত না।  অবশ্য ব্যপারটা অত সহজ নয়। "
- " আমার মনে হয় কাম্যও নয়।  ফলের আশা না থাকলে মানুষের কাজে উদ্যোগ থাকবে কেন ? সে তো উদ্যামহীন হয়ে পড়বে। এবং কাজ করলেও সেটা তার পক্ষে নিতান্তই ইচ্ছা-নিরপেক্ষ যান্ত্রিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে।  আর তাছাড়া এভাবে ভাবতে গেলে একজন সর্বশক্তিমান অদৃশ্য কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিতে হয় , যা একান্তভাবেই মানুষের দায়িত্বশীল কর্মপ্রতিভার উপর অনাস্থা প্রদর্শন। "
সত্যি কথা বলতে কি রাজনৈতিক শিক্ষা না পেলে স্যারের মুখে মুখে এভাবে তর্ক করার শক্তি বা সাহস কোনটাই পেতাম না।  আর আমাদের পরম ভাগ্য যে , স্যারেরা এটাকে কোনদিনই 'ঔদ্ধত্য ' মনে করেন নি।  বরং আমাদের যুক্তিশিলোতে উত্সাহ দিয়েছেন।
বললেন , "রবীন্দ্রনাথের একটা আছে  , ' আমি বহু সাধনায় প্রানপণে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে / এ কৃপাকঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভরে। " এখন বুঝবি না , আরও বড় হ' তখন এর মর্ম বুঝতে পারবি।  যাই হোক , গীতার তাহলে কোনো অংশটাই তোর্  ভাল্লাগেনি ! " বললাম , " ওই একাদশ অধ্যায়ে বিশ্বরূপ দর্শনের অংশটুকু বেশ উন্নত সাহিত্য রস সমৃদ্ধ বলে মনে হলো। "
বললেন , " তবু ভালো ; ঠিক আছে ওই অংশটুকু ভালো করে মুখস্ত করে এসে আমাকে আবৃত্তি করে শোনাবি। যা।  সময় কিন্তু এক সপ্তাহ। "

এক সপ্তাও লাগলো না।  পাঁচ দিনেই মুখস্ত করে ফেললাম।  কিন্তু আবৃত্তি করতে গেলে তো উচ্চারণগুলো সঠিক হওয়া চাই।  পারব না তা নয়। .. তবু , ঠিক কনফিডেন্স পাচ্ছি না।  স্যারকে গিয়ে বললাম।  বললেন , " বল , শুনি। " শোনালাম।  কয়েকটি উচ্চারণ ঠিক করে দিলেন।  বিশেষ করে ব-ফলা  য় -ফলা উচ্চারণের তফাতটা।  বললেন , "অবাঙালিরা তবু কিছুটা ঠিক ঠাক বলে।  ; বাঙালিরা রসনায় সব একাকার। "

তারপর ওঁর সংগ্রহ থেকে আর একটি বই দিয়ে বললেন , " এবার এটা পড় ; যেখানটা ভালো লাগবে মুখস্ত করবি। " দেখলাম , " মেঘদুতম কালিদাসস্য। "

বাড়ি এসে  পড়া শুরু করলাম।  সত্যি বলতে কি , সব কথা যে বুঝতে পারছি  - তা নয় ; কিন্তু , একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে পড়ে  চলেছি। যক্ষের বিরহ যেন আমার সমস্ত মন প্রাণ ছেয়ে একটা ঘনঘোর  বর্ষা দিনের মত ঘিরে ধরল।  আলাদা করে কোনো অংশটুকু মুখস্ত করবো !
প্রথম থেকেই শুরু করলাম " কস্চিত কান্তা বিরাহগুরুণা স্বাধিকার প্রমত্তঃ ,/ শাপেন্স্তং গমিত মহিমা বর্ষাভোগ্যেণ  ভর্তুহ / যক্ষশ্চক্রে জনকতনয়া স্নানপুণ্যদকেষু / স্নিগ্ধচ্ছায়া তরুষু  বসতিং রামগির্যা শ্রমেষু। " নির্জন গ্রাম্য পথে 'ক্যাচোর -কোচর 'করে গরুর গাড়ি চলার ঢিমে লয়ের মন্দাক্রান্তা ছন্দ যেন রামগিরি আশ্রমে বন্দী যক্ষের মন্দগতি জীবযাত্রার প্রতীক হয়ে দেখা দিল।  এক অনাস্বাদিতপূর্ব আবেশ আমার সমস্ত সত্ত্বাকে মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মতো আবিষ্ট করে রাখলো।  এই প্রথম বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার বই পড়ে আমি অমন আত্মহারা হয়ে রইলাম।

এইভাবে দিনের পর দিন তিনি তাঁর সমস্ত মন প্রাণ ঢেলে , শুভ কামনার মঙ্গলদীপ জ্বেলে তাঁর প্রিয় ছাত্রটিকে নির্মাণ করে তুললেন।  পিতৃস্নেহ এর অধিক কী হতে পারে আমার জানা নেই।  নিজের হাতে একটা একটা পাপড়ি খুলে খুলে একটা পদ্মকোরককে প্রস্ফুটিত  শতদল বানাতে চাইলেন।  তাঁর সেই আন্তরিক প্রয়াস সফল হয়েছে কিনা , তা আমি বলতে পারব না। 
কিন্তু একটা ব্যাপারে তাঁর সাফল্যের সার্থকতা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ; তা হলো।  যে আমি সংস্কৃতে একশ'র মধ্যে পনের পেয়ে তাঁরই ডেস্কের ওপর খাতা কুচিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম , সেই আমার মধ্যে তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের এমন আকন্ঠ তৃষ্ণা জাগিয়ে তুলেছিলেন যে , হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পর যখন কার্যতঃ সংস্কৃতলোক থেকে নির্বাসিত হলাম , তখন হেরোইনের নেশা মতো একটু সংস্কৃত পড়ার জন্য  ঘুরে বেরিয়েছি এর দুয়ারে , তার দুয়ারে।

শেষে আমার দাদার এক বন্ধু আমাকে নিয়ে গেলেন বৈঠকখানা রোডে এক পন্ডিতের বাড়ি।  তিনি আমাকে আদ্য মধ্য পরীক্ষাগুলো দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।  তাঁর দয়ায় আবার পড়তে শুরু করলাম অমরকোষ , ,মিত্রলাভ  লঘু-কৌমুদী ইত্যাদি।  কিন্তু সে প্রসঙ্গ বারান্তরে।  একটি একেবারেই অপছন্দের বিষয়ের প্রতি বিশ্বগ্রাসী ভালবাসা জাগিয়ে তুলেছিলেন যে দেবপ্রতিম ঐন্দ্রজালিক , তিনি এক আশ্চর্য  শিক্ষক প্রতাপাদিত্য গঙ্গোপাধ্যায়।

তাঁর কথা শতমুখে বললেও শেষ হবার নয়।

পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম।  বাংলায় অনার্স নিলাম।  সে এক মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মত ওড়ার কলি। তখন সাতের দশকের শুরু।  সমস্ত দেশ যেন এক নতুন সমাজ জন্ম দেবার প্রসব করার যন্ত্রনায় ছটফট করছে।  গ্রামে - গ্রামে কৃষিবিপ্লব  শুরু হয়ে গিয়েছে।  শহরে এসে পড়ছে তারই অভিঘাত।  আমাদের ছাত্র জীবন আরো টালমাটাল। 

ইউনিয়নের দাদারা এসে বলল , "তোমায় সি.আর. হতে হবে।  "অর্থাৎ  ক্লাস রিপ্রেসেনটেটিভ। বললাম , "ঠিক আছে , ভেবে বলব। " ওরা বলল , " ভাবাভাবির সময় নেই। কালই ফর্ম ফিলাপের শেষ দিন। "

শাসক দলের ইউনিয়ন, 'না' বলতেও পারছি না, অথচ ইচ্ছেও নেই এক ফোঁটা। চিন্তার কিছু নেই।  আমার গুরু তো আছেন ।   এলাম তাঁর কাছে।  তখন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।  স্যারের কাছে গিয়ে সমস্ত ইতিবৃত্ত পেশ করলাম।  একটুক্ষণ ভাবলেন ; তারপর বললেন , "এক কাজ কর।  ইলেকশন না হওয়া পর্যন্ত কলেজ যাওয়া বন্ধ কর।  পরে গিয়ে বলবি , অসুখ করেছিল।  ওরা অত মেডিকেল সার্টিফিকেট -টিকেট দেখতে চাইবে না। "

প্রণাম করে চলে এলাম। এবং যথা নির্দেশ কাজ করলাম। এবং ইছাবিরোধী কাজ করার এক অনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেলাম।

এইভাবে বারবার , বারবার তিনি আমাকে  উদ্ধার করেছেন সমূহ বিপদের সর্বনাশা আশঙ্কা থেকে।  মা যেমন করে দুহাতে সন্তানকে আগলে রাখে , ঠিক তেমনি করে।

তারপর , ধীরে ধীরে স্বাভাবিক নিয়মেই দৈনন্দিন যোগাযোগ কমে এলো।  সময় পেলেই ওঁর বাড়ি যেতাম। নতুন কলেজ জীবনের প্রগাঢ় মাদকতায় আমিও মত্ত  হলাম।  উনিও সংসার জীবনে প্রবেশ করলেন।  বিচ্ছেদ দীর্ঘতর হতে শুরু করলো।

কিন্তু চাঁদ আর সাগরে তো অনন্ত বিচ্ছিন্নতা ; তবু পূর্নিমা অমাবস্যায় চাঁদের টানে সাগরের বুকে ভরা -কোটাল আসে কী করে ! এ রহস্য এক অপার রহস্য ; বোধ হয় কখনো তা মেটার নয়।

তার প্রমাণ ?

স্কুল জীবন শেষ হয়েছে প্রায় পনের বছর হয়ে গেল।  ছাত্র জীবনই শেষ। 

প্রচুর টুইশানি করছি। 

বালক ভাইপো এসে বলল , " তোমাকে একটা ছেলে ডাকছে। "

নীচে গেলাম , দেখলাম এক কিশোর।

- "কী ব্যপার , আমায় কিছু বলবে ?"
-হ্যা , প্রতাপবাবু স্যার এই চিঠিটা পাঠিয়েছেন।" নিয়ে পড়লাম , "আজ বিকেলে একবার স্কুলে আসবি ?"
বললাম , "স্যারকে বোলো , আমি যাব। "
গেলাম।  "কী ব্যপার স্যার , হঠাৎ তলব ?"
-"বোস।  .... কী হলো ? অত চিন্তার কিছু নেই।  হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে হলো।  অনেকদিন দেখা হয় নি তো - চা খাবি ?"
কে যেন সপাটে গালে চড় কষালো। " তুই মানুষ ! দ্যাখ মানুষ কাকে বলে , ভালবাসা কাকে বলে -"
আমার গলা বুজে আসছে।  গলা ঝেড়ে বললাম , "খাব স্যার। আওনি খাওয়ালে 'না' বলতে পারি ! তারপর কত কথা হলো।  সুখ দুঃখের কত কথা ! চলে এলাম যখন , মনে হলো গঙ্গাস্নান করে এলাম।

অনেক কাল আগে সুসাহিত্যিক মনোজ বসুর "মানুষ গড়ার কারিগর " নামক  একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। সেটিও একটি মাস্টারমশাই-এর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কাহিনী।  গল্পটা এখন আর মনে নেই ; কিন্তু ওই গ্রন্থ নামটি কোনদিন ভুলবো না।  একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ওই "মানুষ গড়ার কারিগর " শব্দচয়নটি অবিস্মরণীয়। আমার 'স্যার ' ছিলেন তারই উজ্জ্বলতম  দৃষ্টান্ত। 

আরও কয়েক বছর পরের ঘটনা।  বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হচ্ছে।  ইচ্ছে না থাকলেও তাই নিয়ে একটু ব্যস্ত  থাকতে হয়েছে।  হঠাৎ সদর দরজায় করা নাড়ার শব্দ।  নিজেই গিয়ে দরজা খুলি।  স্যার দাঁড়িয়ে।
- " আসুন , আসুন।  হঠাৎ , কী ব্যপার স্যার ? "
-তুই তো ভুলে গেছিস ; আমার তো তোকে এখতে ইচ্ছে হতে পারে - " মরমে মরে গেলাম , নাকি শরমে !

মনে পড়ল , তখন ইলেভেনে পড়ি।  এমনি এক সন্ধ্যায় পাড়ার একটি ছেলে এসে বলল , "পুলুদা , এক ভদ্দরলোক তোমায় খুঁজছে।  সেদিনও তাড়াতাড়ি  নেমে এসে দেখেছিলাম স্যার দাঁড়িয়ে আছেন।  অবাক হয়ে গিয়ে জিগ্গেস করলাম , "আসুন স্যার , বাড়ি চিনলেন কী করে ?" বললেন , " এই ছেলেটিকে জিগ্গেস করে।  চল , তোর্  মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলব।  "

মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম।  বললেন , "রণেন সন্ধ্যে বেলায় কখন পড়তে বসে ? "
মা বললেন ওর কোনো ঠিক নেই।  কখনো সাতটা কখনো সাড়ে সাতটা "
বললেন , "ওকে আমি বলে যাচ্ছি , প্রতিদিন ছটা থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে পড়তে বসবে।  সামনে টেস্ট পরীক্ষা।  না- হলে allowed হবে না।  আমি মাঝে মধ্যে আপনার কাছে এসে  খবর নিয়ে যাব। "
মা অভিভূত।  বললেন , " আপনারাই ওকে মানুষ করে দেবেন। আমাদের আর কিছু করতে হবে না।  আশির্বাদ করুন , ও যেন জীবনে এ ঋণ কখনও না ভোলে।  বসুন।  চা খান। "

তারপর সত্যিই প্রায়মধ্যেই চলে আসতেন।  মায়ের কাছে খোঁজ খবর নিতেন ; এক কাপ চা খেয়ে চলে যেতেন।  বৈষ্ণবশাস্ত্রে "অহৈতুকী কৃপা " বলে একটা কথা আছে।  জানি না , কোন ভাগ্যে , আমি স্যারের এই "অহৈতুকী কৃপা " লাভ করতে পেরেছিলাম।

আজ তিনি দেখাশোনার বাইরে চলে গিয়েছেন।  আমার এই স্মৃতিবন্দনা তাঁকে ছোঁয়ার কথা নয়।  কিন্তু কেমন যেন মনে হয় , আমার এ তর্পণ তাঁর চরণ ছুঁয়ে যাচ্ছে।  ধূপ পুড়ে যায়।  কিন্তু তার গন্ধটুকু ভাসতে থাকে বাতাসে।  তিনি চলে গিয়েহ্ছেন।  কিন্তু তাঁর অদৃশ্য অস্ত্বিত্বের "ওম " টুকু আমাকে ঘিরে আছে। থাকবে।  হয়ত সারা জীবন জুড়ে।

আপনি আমায় শিখিয়েছিলেন একটি অনবদ্য শব্দ , "বসুধৈব কুটুম্বকম। " সেটি আপনার জীবনে আর শব্দমাত্র থাকে নি , হয়েছিল এক সত্যঋদ্ধ জীবনদর্শন।  আপনাকে দেখে শিখেছিলাম সমগ্র বসুধাকে কেমন করে কুটুম্ব বানিয়ে তুলতে হয়।  শিখেছি।  কিন্তু আপনার মত প্রয়োগ করতে পারি নি। আধার সবার এক মাপের হয় না , আপনার বুকের আধারে একটা আকাশ ধরে যেত। অত বড় আধার আমি কোথায় পাবো ! তবু বাকি জীবনটা চেষ্টা করে যাব আমার ছাত্র-ছাত্রী ও কনিষ্ঠদের কাছে আর একটা প্রতাপবাবুস্যার হয়ে উঠতে। 

আপনি শুধু আশির্বাদ করুন , সব কালের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের জীবনে একটা যেন প্রতাপবাবু পায়।  না হলে তাদের ছাত্রজীবন ব্যর্থ বিস্বাদ হয়ে যাবে। 

আর কে বলতে পারে , তাদের মধ্যে থেকে কেউ রণেন্দ্রনাথ না হয়ে নরেন্দ্রনাথ হয়ে উঠবে না  !




সমাপ্ত 
 
 
 
 
 
 








 












 
-----------

Friday, November 21, 2014


গুরবে  নমঃ 

( দ্বিতীয় পর্ব  )

                                                                 - রণেন্দ্রনাথ ধাড়া 

 
 


তারপর , 'বিষাদসিন্ধুর'র সে এক সুদীর্ঘ আখ্যানগাথা।  কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না।  কোনো কাজে মন বসে না।  একলা থাকলেই দুচোখ জলে ভরে ওঠে।  এক এক সময়ে বিষন্নতা এতই ঘনিয়ে আসে যে , সিঁড়ির কোণে  কি বাথরুমে গিয়ে বেশ খানিকটা অশ্রুমোচন করে এসে স্বস্তি পাই।

মনে হয় জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে গেল।  যে আমি সকলের চোখের মণি , যে সর্ব বিষয়ে ইস্কুলের প্রতিনিধিত্ব করে থাকি , সে আমি হেডমাস্টারের এক ঘোষণায় লাস্ট বেঞ্চের মার্কামারা ফেলুরামদের দলে পড়ে গেলাম !! নাঃ , এ অসহ্য ! কিছুতেই এ পরাজয় মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। 

নিচু ক্লাসের ছেলেরা , যাদের চোখে এতদিন আমি ' হীরো ' ছিলাম , এবার তাদের সঙ্গে এক ক্লাসে পেছনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসতে হবে ! অসম্ভব !

অনেক পরে , বাম সরকার যখন পাশ - ফেল প্রথা তুলে দিলো , তখন ভুক্তভুগী হিসেবে তাকে সমর্থন না-করার কোনো কারণ খুঁজে পাই নি। 

নিউটনের তৃতীয় সুত্র বলে , প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমপরিমাণ প্রতিক্রিয়া থাকবে। তো ,আমার 'ফাঁকিবাজি' নামক ক্রিয়ার এই যদি 'প্রতিক্রিয়া' হয় তাহলে 'প্রতিক্রিয়াও' তো একটা 'ক্রিয়াই।' তারও তবে সমপরিমাণ প্রতিক্রিয়া হতে-ই হবে। এবং সেই প্রতিক্রিয়াতেই আমার উন্মুক্ত রাজপথে চলা মনটা  অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে গলিখুঁজির মধ্যে ঢুকে পড়ল। 

হেডমাস্টারকে গিয়ে সরাসরি বললাম , "স্যার , বাড়ি থেকে বলেছে ,'এই রেজাল্ট করে তোমাকে আর নাটক করতে হবে না। আপনি আমায় বাদ দিন। " 'ব্ল্যাকমেল ' কথাটা তখনও শুনি নি ,  আহতমর্যাদাবোধ অজান্তেই আমাকে সেই পথে চালিত করলো , কোথায় যেন পড়েছিলাম , "Necessity is the mother of all inventions "  আমার উঁচু ক্লাসে ওঠার তীব্র "নেসেসিটি'-ই আপন অজ্ঞাতে আমাকে দিয়ে 'ব্লাকমেল' নামক মন্দ কাজটি 'ইনভেন্ট' করিয়ে নিল।

হেডমাস্টারমশাই স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকালেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন , "বাবাকে কাল আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস।" বুকের মধ্যে আসার বিদ্যুত হঠাৎ  ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

হেডমাস্টারের সঙ্গে কী কথা  হয়েছিল জানি না ; বাড়ি ফিরে বাবা বললেন , " তোমাকে আর ক্লাসে উঠতে হবে না। ঐ ক্লাসেই পড়ো। " পরে দাদুকে বলছেন শুনলাম , হেডমাস্টারমশাই নাকি ওকে দিয়ে বন্ডে সই করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।  দেহে মনে শক্ত মনের মানুষ বাবার পক্ষে তা কখনই সম্ভব ছিল না। মুচলেকা দিয়ে ছেলেকে ক্লাসে তলার চেয়ে তিনি বরং ছেলেকে নীচু ক্লাসে রাখতেই বেশী পছন্দ করবেন - এটাই স্বাভাবিক। 

নাটক যথারীতি আরম্ভও হলো।  এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারটিও আমার কপালে জুটল। কিন্তু সে পুরস্কার ও তখন বিষাদ।  ক্লাস শুরু হলে কীভাবে নতুন ছেলেদের সঙ্গে এক ক্লাসে গিয়ে বসবো - সেই চিন্তায় রাতের পর রাত ঘুম ছুটে গেল।  দুর্গা -কালী-শিব-কৃষ্ণ থেকে শেতলা , ষষ্ঠী -ওলাবিবি পর্যন্ত সকলের পায়ে মাথা ঠুকতে লাগলাম , "এই লজ্জা থেকে আমাকে মুক্ত কর ঠাকুর। "

কিন্তু কোনো ঠাকুরই কিছু করলো না ; নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে নতুন ছেলেদের সাথে পুরনো ক্লাসে এসে ঢুকলাম। 

নতমস্তক ; কারুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।  বুকের মধ্যে যন্ত্রণাদীর্ণ রক্তক্ষরণ। .. চোখের আড়ালে হিমায়িত অজস্র অশ্রুকণা  ... আগের ক্লাসের পুরনো বন্ধু যারা ছিল , পিছনের বেঁচে স্বেছাসন নিয়েছে।  নিঃশব্দে গিয়ে তাদের পাশে ঠাঁই নিলাম। চোরা চাউনিতে অনুভব করলাম কয়েকটি বক্রদৃষ্টি আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হায় রে , ওরা তো জানে না , প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে এই অবমাননার দ্বীপে আমি আজ স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি ; স্বখাত সলিলে ডুবে মরেছি। 

নতুন বন্ধুদের (!) সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু হওয়ার  আগেই ক্লাসটিচার এসে ঘরে ঢুকলেন।  হ্যা  , প্রতাপবাবুই। এসেই চোখ তুলে বললেন , "ধাড়া , তুই ওখানে কেন ? সামনে এসে বোস। " প্রথম বেঞ্চের ছেলেরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের পাততাড়ি সরিয়ে এনে বেঞ্চের দু ধার দখল করে নিলো।  উদ্দেশ্য কোনো ভাবেই আমি যেন সেখানে প্রবেশাধিকার না পাই। স্যার বললেন , তুই মাঝখানে ঢুকে গিয়ে বোস। " যথা নির্দেশম তথা কৃতম। ভেতরে ভেতরে গজরালেও কারো আর কিছু বলার সাহস হলো না ; প্রথম দিন বলেই বোধহয়।  পরে অবশ্য প্রান্তবাসী বন্ধুদ্বয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব বেশ গাঢ়-ই হয়েছিল।

কিন্তু সে অনেক পরে। মাঝখানে প্রায় মাস ছয়েকের দীর্ঘ প্রস্তুতি।  অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক। ব্যথা বেদনা যতই থাক , ওই বয়সে  বন্ধুহীন   থাকা যায় না।  কিন্তু আমার ব্যপারটা একটু অন্য রকম ; টিফিন  টাইম-এ কি সিঁড়িতে পুরনো বন্ধুদের দিকে চোখ তুলে চাইতে পারি না , অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে  নিই। ওরাও বিষয়টা খুব উপভোগ করে না নিশ্চই , কিন্তু আমি হীনমন্যতার আঁধার গহ্বরে কুঁকড়ে বসে থাকি।  বুঝতে পারছিলাম , আমি মানুষটা আপাদমস্তক  পাল্টে যাচ্ছি।  যেটি কখনই বাঞ্ছিত পরিবর্তন নয়। কিন্তু আমি নিতান্তই অক্ষম।  গড়ানে - গোলকের ধর্মে অবিরতই নীচের দিকে গড়িয়ে চলেছি।  তখন খড়কুটোর মত নতুন বন্ধুদেরই আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হলাম। হীনমন্যতা মানুষকে  হীন কাজ করিয়ে নেয়।  আগে যা কখনোই পারতাম না , এখন  মনকে দুবার ভাবতে হলো না।  প্রথমেই যা করলাম , তাহলো আস্তিকতা বর্জন , ঈশ্বরবিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দেবার প্রক্রিয়া শুরু করলাম প্রবলভাবে।  যার সূচনা হলো পুজোর ছলে ঠাকুর ঘরে গিয়ে আমাদের গৃহদেবতা গোপাল ঠাকুরকে দু পায়ের পাতার ওপর বসানোর মধ্য দিয়ে। কারণ , গোপালের কাছে আমি প্রথম কাঙালের মত প্রার্থনা করেছিলাম ,"আমাকে ক্লাসে তুলে দাও ঠাকুর " - তিনি সে প্রার্থনা রাখেন নি। এভাবেই নাস্তিকতার যুক্তিতে নিজেকে শানিত করে  তুলতে লাগলাম। যদিও সে যুক্তি খুব বেশি খুঁজতে হয় নি। কারণ , যে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছিলাম , তাতে ধর্মকে বলা হয় - আফিঙ। তার বহুবিধ যুক্তি থরে থরে বইগুলোতে সাজানো। সেগুলো আমার নাস্তিক্য অর্জনের পক্ষে অত্যন্ত সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে।

আর সংকল্প নিলাম , যে আঘাত আমি পেয়েছি , তার শতগুণ প্রত্যাঘাত করতে হবে। কাকে !!! কী জানি ! হয়ত সমাজকে , হয়ত শিক্ষাব্যবস্থাকে , অথবা , হয়ত বা নিজেকেই !

প্রতিজ্ঞা করলাম ভালো ছেলে ' ভাবমূর্তি নিয়ে তো এই ফল হলো ! এবার খারাপ হব।  যতদুর খারাপ হওয়া যায় , কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম হবো , হবোই। এখানেও সেই নিউটনের তৃতীয় সূত্র।

এই অবকাশে আমার বাড়ির কথা একটু বলি , যা এতক্ষণ প্রায় অব্যক্তই রয়ে গেছে।  বাড়িতে , দাদু- দিদা-মা- বাবা ছাড়া আমরা  ; বোন  নেই। 
আর মেয়ে না থাকার কারণে মায়ের আমার বিশ্বগ্রাসী কন্যাতৃষা।  তাই , পাড়ার যত মেয়ে আছে সকলের আবদার আমার মাকে ঘিরে।  কাজেই , ছোটবেলা থেকে মেয়েদের দঙ্গলের মধ্যেই বড় হয়েছি , ভাইবোনের মত। আর মায়ের ছোট ছেলে হওয়ার  সুবাদে সেই মেয়েদের সঙ্গে আমার সখ্য ছিল গলায় গলায়। ছেলেবেলায় ক্রিকেট ফুটবল যত না খেলেছি , তার চেয়ে এক্কা দোক্কা বউ বাটি , বুড়ি ছোঁয়া , কুমিরডাঙা খেলেছি অনেক বেশি।

সেই মেয়েদের মধ্যে জনৈকা শেতাঙ্গিনী ব্রাহ্মনকন্যার কি মতিচ্ছন্নতা ধরেছিল , বেশ কিছুদিন ধরেই ঠারে ঠোরে আভাসে ইঙ্গিতে আমাকে প্রেম নিবেদন করতে শুরু করেছিল।  আমি যথারীতি তাকে পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে চলতাম।  এবার মনে হলো কেনই বা তাকে এড়িয়ে চলব !ওই তো আমার জাহান্নামের পথের দোসর হতে পারে। তাকে প্রশ্রয় দিলাম। গুরুত্ব দিতে শুরু করলাম।  আমার এই আকস্মিক ভাবান্তর তার মনে কী  প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো জানি না , তবে এতদিন যা ছিল আভাসমাত্র , হঠাৎ তা যেন তার দিকে অতি মাত্রায় প্রকট হয়ে উঠলো ।   আমি তো নিজের রাশ আলগা  করেই দিয়েছিলাম , সেই ফাঁক দিয়ে তার দুকুলপ্লাবি বন্যাপ্রেম বন্যার মত প্রবেশ করে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল।  বাস্তবিক , এক চোদ্দ বছরের কিশোর কিশোরীর শরীরে এত রহস্য , এত মাদকতা লুকিয়ে আছে স্বপ্নেও ভাবি নি।  ওর  শরীরীপ্রেমের মদিরতাময় লালসা-পিচ্ছিল পথে ও নিরন্তর আমায় টানতে লাগলো।  হয়ত আমার ভালবাসার ফাঁকি ও ধরতে পেরেছিল। তাই নিজের শরীর ভেট দিয়ে খুশি করে আমায় বাঁধতে চেয়েছিল। কিন্তু ,অচিরেই আমার অবস্থা কাহিল  উঠলো , সে এক প্রাণান্তকর দুর্দশা।  শুনেছি , প্রেমে নাকি এক অপার্থিব অসীম মাধুর্য আছে , সে মধুরতার সন্ধান আমি একেবারেই পাই নি বললে ভুল হবে। তা হলো মদিরতার  মাধুর্য। ; পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মত যা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ; এবং ক্লান্তিকর ও বটে।

' চিত্রাঙ্গদা'য় অর্জুনের সেই হা হুতাশ মনে পড়ে।  "ভস্মে ঢাকে ক্লান্ত হুতাশন ,/ এ খেলা খেলবে আর কতক্ষণ ,/ হে ভগবান। " বাধ্যতামূলক প্রেমের অভিনয় মনকে বড়ই কলুষিত করে , যন্ত্রণাদীর্ণ করে।   অথচ 'পালাবারও পথ নাই। '

ফেল করার পরেই লজ্জায় অভিমানে প্রতাপবাবুর বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছি। তখন আমার নোঙ্গর কাটা নৌকোর মত এলোমেলো ভেসে চলার স্বাধীন দুর্ভাগ্য।  কী ভাগ্যিস , বন্ধুদের মধ্যে পানাসক্ত কেউ ছিল না , না হলে হয়ত পানাদোষ ও ধরে যেত।  সমস্ত দেহ মন জুড়ে তখন রুক্ষতার জয়গান।  বাড়িতে বাবার পেল্লায় পিটুনি খাচ্ছি ; কিন্তু তা-তে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।  সমস্ত সংসারের উপর রাগের ঝাল মেটাচ্ছি মেয়েটির উপর নির্যাতন করে। 

এমতাবস্থায় ষান্মাসিক পরীক্ষা  এসে গেল।  পরীক্ষা কী দিলাম জানি না ; কিন্তু রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল দ্বিতীয় হয়েছি।  ষান্মাসিকের খাতা ছাত্রদের দিয়ে দেওয়া নিয়ম। 

প্রথম পিরিয়ডে  বাংলা।  খাতা দিচ্ছেন ক্লাস টিচার প্রতাপ বাবু।  রোলনম্বর ডেকে সকলের খাতা দিলেন।  আমারটা  বাদ।  আশ্চর্য ! সব শেষে ডাকলেন , "ধাড়া , এদিকে আয়। " ভাবলাম , গেল রে! এবারেও নিশ্চই ডাঁহা গোল্লা ! কিন্তু এও ভাবি , তা- তো হতে পারে না , ফেল করার মত পরীক্ষা তো অন্তত বাংলায় দিই নি  .... তাহলে ! বেশ বিরক্তভাবেই গিয়ে দাঁড়ালাম। 

স্যার রেজিস্টার খাতাটার তলা থেকে আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করা একটা পরীক্ষার খাতা বার করে একটি প্রশ্নের উত্তরে আঙ্গুল দিয়ে বললেন, " এটা জোরে জোরে পড়ে  শোনা। " ভাবলাম নিশ্চই ভুল হয়েছে , এখন ক্লাসের কাছে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পড়তে বলছেন।  বললাম , " কেন , স্যার ? " বললেন , " পড়  না বাঁদর " - অগত্যা  ...

এখনো মনে আছে , প্রশ্নটা ছিল , জগদীশ চন্দ্রের " ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে'র ওপর।  'মহাচক্র প্রবাহের পটভূমিতে লেখক সৃষ্টি ও প্রলয়ের যে রূপ এঁকেছেন তা ব্যখ্যা কর। " - পড়লাম।  শেষ হলে স্যার ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন , " এটাই হচ্ছে আসল উত্তর।   তোমাদের একজন ও সঠিক লিখতে পারো নি , রণেন ছাড়া।  তোমরা সবাই নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশুল পাহাড়কে সৃষ্টি ও প্রলয়ের  প্রতীক হিসেবে ব্যখ্যা করেই থেমে গেছ ; কিন্তু মহাচক্র -প্রবাহের পটভূমিটা ব্যখ্যা করতে পারো নি। একমাত্র রণেনই করেছে।  " স্যারের কথা শুনতে শুনতে কেন জানি না , আমার দু চোখ জলে ভরে এলো।  মনে হলো এই তো যথার্থ গুরু। এক লহমায় প্রিয় ছাত্রের হেঁট মাথা আবার সকলের সামনে উঁচু করে দিলেন।  মনে মনে তাঁর পায়ে লক্ষ্য কোটি প্রণাম জানালাম।

স্যার চলে গেলে আমার খাতাটা নিয়ে টানাটানি পরে গেল।  তথাকথিত যে ছেলেদের কাছে এতদিন আমি ছিলাম ব্রাত্য , আজ হঠাৎই মহাশ্লাঘ্য হয়ে উঠলাম। আমার হীনমন্যতা এক মুহুর্তে কেটে গেল।  হারানো সিংহাসনটি যেন আবার সসম্মানে ফিরে পেলাম।

কিশোর বয়সের একটা অন্তর্লীন শুচিতা থাকে।  অনেকটা গঙ্গার জলের মতো।  আবর্জনা কখনো স্পর্শ করলেও সেই স্রোতস্বিনী শুচিতার টানে অচিরেই কোথায় ভেসে চলে যায়।

বেশিদিন নির্বাসিত থাকতে হলো না।

শ্যামসুন্দর বাবু , রুপেন বাবুদের প্রত্যক্ষ মদতে ইতিমধ্যেই স্কুলে ছাত্র ইউনিয়ন তৈরী হয়েছিল।  এ বিষয়ে সম্ভবতঃ আমাদের স্কুলই পথিকৃত। ইউনিয়নের নানা প্রয়োজনে স্যারেরাই আমাদের বিভিন্ন দক্ষতা ও নৈপুন্যগুলো কাজে লাগাতে লাগলেন।  ব্যক্তিত্বকে কুঁচকে গুটিয়ে রাখার স্বভাব বিরোধী যন্ত্রণাদায়ক লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়ে আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। 

বন্ধুরা মিলে দেয়াল পত্রিকা বের করলাম , শ্যামসুন্দর বাবু তার নাম দিলেন 'দিশারী।'  আমি হলাম তার সম্পাদক। শনিবার ছুটির পর একটি করে বিতর্ক সভার আয়োজন হলো।  আমিই তার আহ্বায়ক। আমার শুকিয়ে যাওয়া গাঙে আবার ষাঁড়াষাঁড়ি বান।  ডাকলো ; কাজের বান।  জীবনটা আবার  ছন্দে ভরে উঠলো -গতির আনন্দে।

এমনি দিনে টিফিন টাইমে একদিন 'স্যার' ডাকলেন টিচার্স রুমে।  বললেন , "বাড়িতে আসা বন্ধ করলি কেন ? " আমি আমতা আমতা করে কী যেন বলতে গেলাম ; ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে আদেশ দিলেন , " কাল থেকে আবার আসবি। ভুল যেন না হয়। "

আবার শুরু হলো সেই পুরনো রুটিন।  মনে হলো আমার কিছুই হারায় নি।  একটা বছরের সব ক্লিনতা , মালিন্য যেন এক ফুত্কারে কোথায় উড়ে গেছে।

পুজোর ছুটিতে অর্ডার হলো খাওয়া দাওয়া করে সকাল দশটায় হাজিরা দেওয়ার।  দিলাম।  ভাবলাম, দুপুরের আগেই ফিরে আসবো।  কিন্তু ফেরাটা কি আমার হাতে ! একটা-দেড়টা নাগাদ যখন ফেরার জন্য উশখুশ করছি , বললেন , "এই দুপুর রোদ্দুরে কোথায় যাবি ? বোস ; ইংরেজি গ্রামারটা বার কর। analysis গুলো দেখবো।" - অবাক হলাম।  উনি তো বাংলা - সংস্কৃতর স্যার , ইংরেজিও পড়াবেন  ... !! তিন  সেনটেন্স ও তার ভাগ গুলো জলের মত বুঝিয়ে দিলেন।  ছুটি হলো যখন , তখন চারটে  বেজে গেছে।

এইটাই রুটিন হয়ে দাঁড়ালো , দশটা থেকে চারটে , প্রতিদিন , রবিবারেও ছুটি নেই। বলাই বাহুল্য , তখন দুরদর্শন সুদুর পরাহত। বাড়িতে রেডিও-ই একমাত্র প্রমোদ-মাধ্যম।  মুষ্টিমেয় যাদের বাড়িতে গ্রামোফোন আছে , তারা তো ঈর্ষার পাত্র।  আমরা কখনই তত বড়লোক ছিলাম  না।  আর , বাইরে তখন সিনেমার যুগ।  হলে উত্তমের 'বই' এলে তো আর কথাই  নেই , ফাটাফাটি কান্ড একেবারে।

হাতিবাগানের মুখেই রাধা সিনেমা।  স্যারের বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে।  সেখানে উত্তম-অঞ্জনার 'রাজদ্রোহী' এসেছে।  বন্ধুরা  মারপিঠ করে টিকিট জোগার  করেছে। আড়াইটেয় শো।

দুটো থেকেই উঠব উঠব করছি। স্যারের মাতৃদৃষ্টিতে কিছুই লুকোনো। বললেন , " কী হলো ? কোথাও যাবি ?"
বললাম , " হ্যা , মানে প্রণবরা টিকেট কাটিয়েছে  .... "
- "টিকিট ! কিসের !"
- "ওই। .. রাধা সিনেমায়  .... রাজদ্রোহী হচ্ছে। .. "
- "রাজদ্রোহী বহুবার আসবে। কিন্তু এই বছরটাও গেলে আর ফিরবে না , এমনিতেই একটা বছর নষ্ট হয়েছে। ... বসে পড়।  অন্য সব পরে হবে '. চোখে জল এসে গেল ; না , ওঁর মহানুভবতার জন্য নয়।  বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করার এমন একটি সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট হলো বলে।  বাস্তবিক পক্ষে সেদিন ওঁর এই শুভাঙ্কর শাসনের মহত্ব বোঝার মত মানসিক প্রস্তুতি মোটেই  ছিল না ; থাকার কথাও নয়।  এত বছরের ব্যবধানে , যখন তিনি আর কোনদিন ই আমার চর্মচক্ষে ধরা দেবেন না , তখন এসব দিনের কথা ভেবে আবারও চোখে জল আসে। যদিও তা সেদিনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর কারণে।

 ভাগ্যিস , পুজোর ছুটির প্রায় শুরুতেই এই ঘটনা ঘটেছিল - লম্বা ছুটির অবকাশে বন্ধুদের মনে এ ঘটনার জ্বালা উপশম  হবার অনেকটা সময় পাওয়া গেছে ; না হলে , পর দিন ক্লাস থাকলে বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে  যেতো। 

ছুটির পর অ্যানুয়াল পরীক্ষা। দিলাম। গতবারের পরীক্ষাদর্শ বর্জন করতে বাধ্য হলাম ; এবং যথাবিধি স্ট্যান্ড ও করলাম।  তবে প্রথম নয়। দ্বিতীয় স্থান পেলাম। তবে সান্ত্বনা এই , প্রথম হয়েছিল আমাদের ফেল করা ছেলেদেরই একজন।  সম্ভবতঃ কল্যাণ।  নতুন ব্যাচের ছেলেদের দাঁত ফোটাতে দিই নি। 

ক্লাস টেনে উঠলাম।  সমস্ত বাংলা তখন উত্তাল। ছাত্র আন্দোলনের বড় বড় ঢেউ তখন আছড়ে পড়ছে কলেজ স্ট্রীটের  লোহা বাঁধা ট্রাম পথের ওপর।  শ্যামসুন্দরবাবুর নেতৃত্বে আমরাও তখন ভীষণভাবে তাতে সামিল। 'স্যার' বললেন , "শুধু ঝান্ডা নিয়ে মিটিং মিছিল করলেই মানুষের চেতনা জাগানো যাবে না। চাই শিক্ষা , ব্যপকহারে শিক্ষার বিস্তার ;  চেষ্টা কর। "ব্যস , আর যায় কোথায় !ইস্কুলের অদুরেই ছিল ছানাপট্টি বস্তি।  এখনো আছে।  এক শনিবার বিকেলে বিতর্কসভার পর বন্ধুবান্ধব নিয়ে  গেলাম বস্তি অভিযানে।  ঘরে ঘরে দরজায় দরজায় ঘুরলাম। মা-দের বললাম ,"আপনার ছেলেমেয়েদের আমাদের ইস্কুলে পাঠান, বিকেলবেলা, পাঁচটার সময়ে। " তাঁরা কিছুটা হতভম্ব।  বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায়  দুলছেন। 

প্রথম দিন পাঁচজন। এলো।  মনটা একটু হলেও দমে  গেল।  ...তবু  ঠিক আছে। ... পৃথিবীর বৃহত্তম যে পার্টি , কমুনিস্ট পার্টি , প্রথমে পাঁচ জনকে নিয়েই তৈরী হয়েছিল , স্যারদের কাছেই শোনা।  স্যারেরাই চক ডাস্টারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পাঁচ জনকে সাথী করেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো।  আমরা অর্থাৎ  শিক্ষকরা প্রায়  জনা দশেক।

অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যের খাতিরে বলতেই হবে , পরের সপ্তাহেই ছাত্র  দাঁড়ালো বিরাশিতে।  হ্যা  , আটের পিঠে দুই - বিরাশি।

মনে আছে , নিমু গোস্বামী লেন থেকে এক মা এসেছেন আধ  হাত ঘোমটা টেনে ; আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন , আমার ছেলে দুটোকে মানুষ করে দাও বাবা ; বড্ড গরীব আমরা।  মাস্টার রাখবার খ্যামতা নেই। ..." আর কিছু বলতে পারলেন না , আমার দুহাতের পিঠে টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো। আমার গলা-ও তখন বুজে এসেছে ; কোনক্রমে বললাম।  " মা গো , আমি যদি মানুষ হই , তাহলে তোমার ছেলেরাও মানুষ হবে , মা। হবেই হবে - কথা দিলাম।"

জানি না , সে ছেলেরা এখন কোথায় - কী কাজকর্ম করছে।  সে মা-ও আর আছে কিনা , তা-ও জানি না।  তবে যে আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে সেদিনের ওই ক্রন্দসী মা-কে অতবড় কথা আমি দিয়েছিলাম , বিনয়ের সঙ্গে বলছি , সে আদর্শের দীপ আমার বুকের মধ্যে আজও জ্বলজ্বল করছে এবং এই দীপের শিখাটি জ্বালিয়েছিলেন যিনি , তিনি আমার চির আরাধ্য আচার্য্যদেব , প্রতাপাদিত্য গঙ্গোপাধ্যায়।

পৌনে পাঁচটায় ছুটির ঘন্টা পড়ত ।  বেরিয়ে দেখতাম গেটের দুপাশে রকের ওপর ছোট ছোট গোলাপ চারার সারী বসিয়ে গেছে , কারোর বগলে ভাঙ্গা স্লেট , ছেঁড়া 'হাসিখুশি ' , কারুর কাঁধে সস্তা কাপড়ের ব্যাগ , কারোর বা পুঁথি পত্তরের বাহন হিসেবে বাজারের থলি সম্বল।  ছুটি হতেই তারা ওই হই করে ঢুকে পড়ত স্কুলে। একজনেরও পোশাক আশাক পাতে পড়ার যোগ্য নয়। নাকের তলায় শুকনো সর্দির দাগ ; কারো আবার কাজল পরা চোখের কোলে পিচুটি। আধ ময়লা ছেঁড়া খোঁড়া জামাপ্যান্ট। ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা কিছু কম। অমর - অনাথ-বুড়ো -হারা-খোকা-বাসু -রাজা-মেথর-কমলা-কল্যানী। ..আরও কত সব নাম। আমাদের   নবীন কৈশোর দায়িত্বশীল কাজের আনন্দে ভরে উঠলো।

ছুটির পর বাড়ি ফেরা হয় না। খিদেতে পেট জ্বলে। বুঝতে পেরে স্যারেরা চাঁদা তুলে -- কচুরি সিঙ্গারা- জিলিপি আনাতেন। প্রতিদিন। নিয়ম করে। প্রতিদিন সে এক ফিস্ট।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সোয়া ছ-টা  , সারে ছ-টা হয়ে যেত। প্রথম প্রথম বলতাম , "স্যারেরা স্পেশাল ক্লাস নিচ্ছেন" স্কুলের সদ্য প্রাক্তন আমার দাদা একদিন সব ফাঁস করে দিল।ভাবলাম,  বাবা এবার পিঠে বেত ভাঙবে। কিন্তু অবাক কান্ড। বাবার দিক থেকে সেরকম  কোনো  বিরূপ  প্রতিক্রিয়ই  দেখা গেল না। কিল খেয়ে কিল হজম করার মত তিনি তুষ্নি ভাব নিলেন। "মৌনং সম্মতি লক্ষণম "অতএব তরতরিয়ে এগিয়ে চলল আমার সমাজসেবার তরণী।

ইতিমধ্যে কৃষি বিপ্লবের ব্রত নিয়ে চাকরি ছেড়ে শ্যামসুন্দর বাবু গ্রামে চলে গেলেন। সঙ্গে গেল স্বপন মজুমদার , দীপক পাল প্রমুখ কয়েকজন ছাত্র।

আমাদের বুকের গভীরে আদর্শের জোয়ার  আরও বেগবান হয়ে উঠলো। রুপেন বাবুকে গিয়ে বললাম , সামনের ১১ই সেপ্টেম্বর আমাদের ছাত্র ছাত্রী দের নিয়ে শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মোৎসর্গ দিবস উদযাপন করব। স্যার তো এক কথায় রাজী। সেদিন ওই হতদরিদ্র শিশুদের কাছে ক্ষুদিরামের আত্মোৎসর্গের ইতিবৃত্ত বোঝাতে আমাদের জিভে যেন সরস্বতী ( যদি থাকেন ) ভর করেছিল।

ইউনিয়নের প্রভাবে স্কুলে একটা  শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল। টোকাটুকি সম্পূর্ণ বন্ধ। কখনো যদি তেমন কোনো ঘটনার আভাস মেলে মাস্টারমশাইদের আর কিছু বলতে হচ্ছে মা। ছাত্র প্রতিনিধিরাই গিয়ে তাকে যথারীতি শাসিত করে আসছে।  পারস্পরিক প্রতিযোগীতা উধাও। সকলেই সকলের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিছে। এ যেন এক অপূর্ব প্রেমময় শিক্ষা  পরিবেশ।

এদিকে উত্তুঙ্গ আদর্শবোধের ছোয়াঁচ লাগা আমার তরুণ জীবন তখন আত্মগ্লানিতে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।   গ্লানির কারণ সেই পেম-পটিয়সী কিশোরী। তার প্রতি আমার আকন্ঠ আগ্রহ ততদিনে গলগ্রহে পর্যবসিত হয়েছে।  কি করে তাকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারি আমার দিবারাত্রির দুশ্চিন্তা তাই।

তার সঙ্গে অমানুষিক দুর্ব্যবহার  শুরু করলাম। যতভাবে পারা যায় তাকে লোকসমক্ষে হেয় করার একটা পৈশাচিক নেশা যেন আমায় পেয়ে বসলো। অথচ বয়সোচিত প্রাকৃতিক কারণে তার সঙ্গ সুখ ও পুরোপুরি এড়াতে পারি না।  এই এক প্রচন্ড অস্বস্তিকর দোলাচলের মধ্যে জীবনটা পাঁকে পঙ্কজে অতিবাহিত হতে লাগলো। এত অসম্মাননাতেও তার দিক থেকে কোনো ভাবান্তর নেই।

এই দ্বিধাদীর্ণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার  জন্য প্রাণটা তখন আকুলি বিকুলি করছে। এক মর্মান্তিক পাপবোধে জর্জরিত হচ্ছি। এদিকে আমি যত ছাড়াতে  চাই , সে তত যেন আমাকেই জড়িয়ে ধরে , এক লালাসিক্ত মাকড়সার মতো।

আমার এই নিদারুণ  যন্ত্রণার কথা কাকে বলি ! সেই বয়সে তেমন উপযুক্ত বন্ধু কোথায় ! পুরনো বন্ধুরা তো গত বছরেই বিদায় নিয়েছে। এখন , যারা তাদের সঙ্গে পরিচয় তো সবেমাত্র এক বছর। পাড়ার বন্ধুদের বলি যে তারও উপায় নেই ; কারণ , কন্যেটি আবার আমার ই এক বন্ধুর বোন। ব্যাপারটা পাঁচ কান হলে কেলেঙ্কারী কান্ড হয়ে যাবে ; দু'. বাড়িতেই।  কিশোর বয়সের রোমান্টিক প্রেম তখন আমার গলায় ফাঁস হয়ে বসেছে।   জীভ বেরিয়ে আসার উপক্রম।  ছাড়িয়ে নেবার যত চেষ্টা করছি , তত চেপে বসছে। সে এক প্রাণান্তকর অবস্থা।

অনন্যোপায় হয়ে গুরুর শরণ নিতেই হলো। স্কুলের  শেষে এক প্রাক-সন্ধ্যার অবকাশে স্যারের কাছে গিয়ে প্রায় আত্মসমর্পণ করলাম।  সব শুনে উনি কয়েক মুহুর্তের জন্য গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর একটু গলা ঝেড়ে আমায় অমোঘ দু'তিনটি কথা বললেন।  কথাগুলি এত বছর বাদে এখনো আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়।  বললেন , " দ্যাখ , মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অন্তত দু বছর আগে মনের দিক থেকে অ্যাডাল্ট হয়ে যায়।  ওই মেয়েটি যা করছে , তা আর নিছক রোমান্স নয়। ও তোকে  গভীরভাবে  ভালোবেসে ফেলেছে।  যেমন বৌ তার স্বামীকে ভালবাসে।  এতে ওর অপরাধ কিছু নেই। এ টা ওর বয়সের ধর্ম।  ও নিজেও তা জানে ; তাই ওর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ ও নেই।  কিন্তু এতে  তোর্ ক্ষতি হবে ; কেরিয়ারের ক্ষতি।  তুই এখনো ম্যাচিওরড নোস্। তোর্ সামনে এখন লম্বা ভবিষ্যত পরে আছে। তোকে দাঁড়াতে হবে , সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হতে হবে।  ভালবাসার  যেমন সুখ আছে , তেমনি দায়িত্বও আছে। মহাদায়িত্ব।  কোনরকম দায়িত্বগ্রহণের পক্ষে তুই একেবারেই তৈরী হোস নি এখনো। আমার মনে হয় , মেয়েটিকে তুই এই সব কথা খুলে বল  ,এখনই। ও নিশ্চই সব বুঝতে পারবে। দেখবি তখন নিজেই সরে যাবে।  আর  যদি না যায় , তখন অপেক্ষা করতে বলবি।  বলবি ,নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আবার তুই ওর সঙ্গে  নতুন করে সম্পর্ক শুরু করবি।  দ্যাখ না , কী হয় - "

গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে একদিন নির্জন ছাদে , যখন আসন্ন-সন্ধ্যার গুড়ো গুড়ো  অন্ধকার আমাদের  ঘিরে  ধরেছে , তখন ওর পক্ষে ঘনিষ্ঠতম আর আমার পক্ষে দুর্বলতম মুহুর্তে ওর  কানের কাছে মুখ এনে ভাঙাচোরা গলায় ফিসফিস করে গেয়ে উঠলাম , " পৃথিবী আমারে চায়,/রেখো না বেঁধে আমায়/খুলে দাও প্রিয়া /খুলে দাও বাহুডোর ".
ও মজা পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমিও হাসলাম ; তবে কাষ্ঠহাসি। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম , " সত্যি-ই এবার আমার বিদায় নেবার পালা। এক্ষুনি যেমন হাসলে , তেমনি হাসিমুখে আমায় বিদায় দিতে হবে। "
বললে- " যাও না - কে আটকেছে ?"
বললাম , " সত্যি বলছ তো - ? এ বিদায় কিন্তু চিরবিদায়।  "
- "মানে ?"
- " ,আনে , আমাদের সম্পর্কটা এখানেই শেষ করতে চাইছি। পড়াশুনার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে "

নতমুখে অনেকক্ষণ চুপ  করে রইলো। ওই অন্ধকারেও হঠাৎ লক্ষ্য করলাম , নতমুখী পদ্মপলাশ থেকে বিন্দু  বিন্দু জল গন্ড বেয়ে চিবুকে এসে পড়ছে। আমি অবাক হবার ভান করে বললাম ," এমা  কাঁদছ ! কেন এতে কান্নার কী হলো ? এ তো সাময়িক বিরতি -"
আমরা লোকসমক্ষে তুই তুকারী করলেও আড়ালে তুমি-ই বলতাম।
ও ধরা গলায় বলল , " জানতাম এরাম কিছু হবে।  কিছুদিন ধরে তোমার ব্যবহারেই পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম।  আমাকে তোমার আর ভাল্লাগছে না।  সেটা পরিস্কার করে বললেই পারতে - এত ভনিতা করার কী দরকার ছিল ! আমি চলে যাচ্ছি।  আর কোনো দিন তোমাদের বাড়ি আসব না। " বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
এত মহা ফ্যাসাদ হলো। ... প্রথম ওষুধে কাজ হলো না। এবার তূণ থেকে ব্রহ্মাস্তটি  বার করলাম , " আরে দ্যুত ,এত সাময়িক। সাময়িক বিরতি।  বল্লাম না ! বড় হয়ে রোজগারপাতি করে তোমাকেই বিয়ে করব ? --- মাঝখানে খালি ক'টা  বছর। .... এই ক'টা  বছর আমি তোমারই থাকব।  শুধু আমাদের এই সম্পর্কটা থাকবে না। বোকা  মেয়ে কোথাকার; চোখ মোছো  , মোছো চোখ - " ও আর একটা কথাও না বলে মুখ ফিরিয়ে এক ছুটে ছাদ থেকে নেমে ওদের বাড়ি ভ্হ্কলে গেল।

সেদিন ওকে  যে কথা দিয়েছিলাম , তখনই জানি , সে কথা আমি কোনদিনই রাখতে পারব না , বা বলা যেতে পারে , রাখব না। কারণ , তার অনেক আগেই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে , বিয়ে থা করে, নেরিগেন্দী বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে, রেশন -বাজার করে ধম্ম আমার পোষাবে না।  আমি কবিতা বলব , নাটক করব , দেশের কাজ করব। ....... রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটি মনে মনে খুব আওড়াতুম , " বিশ্বজগত আমারে মাগিলে , কে মোর আত্মপর ! / আমার দেবতা আমাতে জাগিলে কোথায় আমার ঘর !"

পরে ওই বিরহিনীর বিয়ে হয়ে যায় আমাদেরই দূরসম্পর্কীয় এক  যুবকের সাথে।  আরও পরে , আমার শিষ্য -শিষ্যা মন্ডলী অন্তর্গতা তারই এক রুপসী কনিষ্ঠা " বয়সকালে আমার কী দুর্দশা হবে , কে দেখবে আমাকে " এই দুর্ভাবনার বশবর্তী হয়ে প্রেম নিবেদন করতে এলে , তাকেও রবীন্দ্রনাথ শুনিয়ে বিদায় দিয়েছিলাম , " মোর তরে করিও না শোক / আমার রয়েছে কর্ম , আমার রয়েছে বিশ্বলোক। "

কিন্তু সে আলোচনার ক্ষেত্র অন্যত্র।
 
  
 
 
 
(অন্তিম পর্ব আগামী শুক্রবার )

 

Friday, November 14, 2014

অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য 
জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া 
চক্ষুরুন্মিলিত্যং যেন 
তস্মেই  শ্রী গুরবে নমঃ। 
 
 
প্রাক সত্তর দশকের সেই উত্তাল সময়। 
 
যখন বাংলার যৌবন রাগে - ক্ষোভে - প্রতিবাদে - প্রতিরোধে ভিসুভিয়াসের মত টগবগ করে ফুটছে। বাংলার বুকের ওপর এক নব -অগ্নিযুযুগ নেমে এসেছে। ছেলেরা দলে দলে গ্রামে যাচ্ছে কৃষিবিপ্লবের আগুন জ্বালাতে।  শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছাত্ররা আগুন জ্জ্বালাচ্ছে।  কোন এক কবি লিখে ফেললেন , " স্কুল কলেজে  খিল / রাস্তায় মিছিল / ক্র্যকারে কাঁপে রাজপথ / কিনু গোয়ালার গলি / হীরের টুকরো ছেলেরা  সব অশ্বমেধের বলি । / বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোত্স্না। "
 
বাস্তবিক।  কলকাতার পথে পথে  সি. আর. পি -র পাহারা। ছাত্রদের গলায় স্লোগান , "পুলিশ তুমি যতই মার ,মাইনে তোমার  একশ বারো । " রক্তাক্ত রাজপথ।  স্কুল কলেজের সামনে সি.আর. পি -র গুলিতে ঝাঁঝরা ছাত্রদের লাশ। 
 
৬৫।  দিল্লির মসনদে ইন্দিরা গান্ধী।  পাকিস্তানের  যুদ্ধ। কিছু পরেই তাশখন্দে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর বিতর্কিত মহাপ্রয়ান।  ছাত্রদের মিছিলে আওয়াজ ওঠে " দেশবাসী যখন চায় বস্ত্র ও খাদ্য / সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য। "  সে মিছিলে মেহনতী মানুষ ও সামিল। 
 
এই অগ্নিময় মহাযজ্ঞে আমার ছোট অনামী ইস্কুলের উঁচু ছাত্রবন্ধুরাও সামিল।  মুখ্যত যাঁর নেতৃত্বে , তিনি আমাদের নবাগত শিক্ষক শ্যামসুন্দর বোস।  ইংরেজির শিক্ষক ; কিন্তু , পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমাদের রাজনীতির ক্লাসও নিতে শুরু করলেন।  বোঝালেন মার্কস বর্ণিত সমাজবিবর্তনের ধারাপাত। বোঝালেন , শুরুতে কেউ ই অতুল ধনসম্পত্তি নিয়ে জন্মায় নি।  শুরুতে যখন  আদিম সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত  ছিল , তখন মানুষ দলবদ্ধ ভাবে কৌমজীবন যাপন করত।  ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু ছিল না।  লড়াই হত বন জঙ্গলের অধিকার নিয়ে দলের সঙ্গে দলের।  আর সাধারণ শত্রু ছিল হিংস্র পশু ও বন্য স্বাপদের দল।  পরে কৃষিযুগ থেকে দলপতিদের ভোগী জীবনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি , সঞ্চয়লালসা ইত্যাদি সামাজিক পাপের উদ্ভব। 
 
বোঝালেন , দ্বান্দিক বস্তুবাদ।  বস্তুই ভাবের জনক ।  রবীন্দ্রনাথ ভুল বলেছেন , " আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ / চুনি উঠলো রাঙ্গা হয়ে।  " - না।  কারুর চেতনার রঙে পান্না সবুজ হয় নি।  চুনি রাঙ্গা হয়ে ওঠে নি।  পান্না সবুজই।  তাই , আমাদের চেতনায় , তা সবুজ বলে প্রতিভাত হয়।  চুনি নিজে রাঙ্গা বলেই আমাদের চেতনাকে রাঙিয়ে তোলে।  বস্তু থেকেই ভাব চেতনার জন্ম।  কথায় বলে " আছে বস্তু , তায় বিচার " এর অন্যথা হলে তাকে নির্বাস্তু ভাববাদ বলা হবে ।  যা বস্তুত পক্ষে অলীক ও নিরালম্ব। 
 
 
এমনই উত্তুঙ্গ সময়ে মূলত সংস্কৃত পড়ানোর জন্য ইস্কুলে একজন নতুন শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটল।  প্রতাপাদিত্য গঙ্গোপাধ্যায়।  বছর ২৪-২৫ বয়স মেরে কেটে।  আমরা তখন ক্লাস নাইন। বয়সটা সহজেই অনুমেয়।  কাজেই শিক্ষক না হয়ে অচিরেই যে তিনি 'দাদা' হয়ে উঠবেন , বলা বাহুল্য।  যদিও আমি কখনো দাদা বলি নি।  'স্যার' ই বলে এসেছি বরাবর। 
 
একেবারে ক্লাস টিচার হয়ে এলেন। প্রথম পিরিয়ডে 'বাংলা ' এবং টিফিনের পর , অর্থাৎ , ফিফথ পিরিয়ডে সংস্কৃত। 
 
খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন - বলতে পারব না।  বরং , ঠিক উল্টো ।  পরীক্ষার হলে 'বাঘ ' হওয়ার সুত্রে ছাত্রদরদী ভাবমূর্তিতে টান।  তিনি নাকি ডান দিকে ফিরে বাঁ দিকটা নজর রাখতেন।  যা নজরদারির পক্ষে একেবারে বিরল ব্যতিক্রম।  এবং নকলনবিশ ছাত্রদের পক্ষে সমূহ বিপজ্জনক।  যদিও সে অভিজ্ঞতা আমার কখনো হয় নি।  কারণ , স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত কোনদিন ও নকল করার কলাকৌশল গুলো আয়ত্ত করতে পারিনি।  এটি আমার অন্যতম অক্ষমতা।

সে বছর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় সংস্কৃতে একশোর মধ্যে পনের  পেলাম।  সে খাতা তো আর গার্জেনদের দেখানো যায় না - তাই,  পত্রপাঠ সে-খানি কুচিয়ে শতছিন্ন করে স্যারের সামনেই ডেস্কের উপর ছড়িয়ে দিয়ে এলাম।  আর ,পড় তো পড় , সেই মুহুর্তেই পিরিয়ড শেষের ঘন্টা পড়ে গেল।

স্যার তো স্তম্ভিত।  ছাত্রের স্পর্ধায় হতবাক। যাবার সময় খালি  জলদমন্দ্রে বললেন , " ছুটির পর দেখা করবি।  "

স্যারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুরা আমায় নিয়ে পড়ল। এই মারে তো সেই মারে ! "আর দেখতে হবে না।  এ বছর ঠিক ফেল মারবি।  ক্লাস টিচারকে চটিয়েছিস ! " কেউ বলল , " ছুটির সময়ে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিবি। .." ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কিন্তু পরের ঘটনা যা ঘটল, তাতে কোনো হিন্দিভাষী হলে বলতাম 'পিকচার অভি বাকি হ্যায়  ওস্তাদ।  ইয়ে গুরু শিষ্যকা সওয়াল।  বিচ মে ঘুস না মানা হ্যায়। " বিশেষত সে কেস যখন রণেন্দ্র-প্রতাপে। 

ছুটির পর দুরু দুরু যখন টিচার'স রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম,  কপালে বিন বিনে  দিয়েছে , গলা শুকিয়ে কাঠ।  তখন তো আর এখনকার মত ওয়াটার বটলের রেওয়াজ ছিল না - তাই প্রায় ঠোঁট চাটতে চাটতেই তাঁর সম্মুখীন হলাম। 

বললেন , "ব্যকরণ কৌমুদীটা বার কর। " করলাম। 
-" হেল্পস টু স্টাডি এনেছিস ? "
 বললাম , " হ্যা "
- " বার কর।  " যথা নির্দেশম তথা কৃতম। "
বললেন , "কৌমুদী থেকে "নর " আর " লতা " শব্দরূপ দুটো , "ভূ " আর 'গম ' ধাতুরূপ দুটো , আর এ বইটা থেকে চতুর্থী পর্যন্ত বিভক্তির সুত্রগুলো মুখস্ত করে , কাল সকাল ঠিক সাতটায়  আসবি।  "
মিনমিন করে বলতে গেলাম , "আপনার বাড়ি তো  আমি চিনি না স্যার। ......... " এক থাপ্পরে সে কথা থামিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন , "তোর  বন্ধুদের অনেকে আমার বাড়ি চেনে। তাদের কাছ থেকে জেনে নিবি। এখন যা - চলে যা। "

বন্ধুরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল , প্রতাপবাবুর হাতে রণেনের কী দুর্দশা হয় তা স্বচক্ষে চাক্ষুষ করবে বলে। জিজ্ঞেস করতে সত্যিই জানা গেল প্রণবের পাড়াতেই উনি থাকেন ; হাতিবাগানের দিক থেকে হরি ঘোষ স্ট্রীটের প্রথম বাড়িটাই।  দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ডান দিকে প্রথম ঘর।

তারপর সে এক অসাধ্যসাধনের ইতিকথা।  যা কখনো করি নি - তাই করলাম।  প্রায় সারা রাত্রি জেগে মুখস্ত করলাম।  ছোটবেলা থেকেই আবৃত্তি করার সুত্রে মুখস্তবিদ্যেটা প্রায় করায়ত্ত। 
পর দিন  গুটি গুটি পায়ে স্যারের দোতলার বারান্দাওয়ালা ঘরটিতে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন পাক্কা সওয়া সাতটা। 

 এই শুরু হলো পরশ পাথরের ছোঁয়ায় এক মরচে পড়া লোহার নবজন্মের বৃত্তান্ত।  প্রতিদিন।  প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে সারে নটা। তারপর বাড়িতে এসেই স্নান খাওয়া সেরে স্কুলে দৌড়োনো। এগারটায় ক্লাস।  প্রথম পিরিয়ড আবার তাঁরই।  এক মিনিট দেরী হওয়ার  জো নেই।  তাহলেই গেটের বাইরে নীল ডাউন।

এদিকে রাজনীতির প্রভাবে এবং সময়ের প্রভাবে ততদিনে জেনে গিয়েছি ,যে  এ শিক্ষাব্যবস্থা কত ভুয়ো ; এই বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে যত বেশি ডিগ্রী পায় , সে তত বড় গর্দভ।  কাজেই , বৃহত্তর গর্দভ হওয়ার দিকে আমার কোনো ঝোঁকই দেখা  গেল না।  অনেক পরে বুঝেছি , সেটা ছিল আমার ফাঁকিবাজির একটা জুৎসই কৈফিয়ত মাত্র।  শুধু আমার নয় , আমাদের।  আমাদের প্রজন্মের হতভাগ্য কিশোর কিশোরীদের।

কিন্তু আর একটা মতও  সমান্তরাল ভাবে এসে পৌছচ্ছিল। দ্বন্দের নিয়মে সব কিছুরই দুটো দিক থাকবে - ইতিবাচক আর নেতিবাচক।  তাহলে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থারও নিশ্চই দুটো দিক আছে।  তার নেতিবাচক দিকটা পরিহার করলেও , ইতিবাচক দিকটা গ্রহণ করতে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন ! সেই বয়সে এই তত্তের প্রবক্তা হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রতাপবাবু স্যার।

তিনি বোঝালেন , "কোনো জিনিস পরিহার করতে গেলেও জানতে হবে , কী কী কারণে তা পরিহর্তব্য।  আর তা গ্রহণ করতে গেলে তো জানতে। হবেই।  খানিকটা রামকৃষ্ণের পরমহংস তত্তের মতো ; দুধে জল মেশানো থাকলে হাঁস নাকি দুধ টুকুই পান করে , জলটা পরে থাকে।  আমাদের তেমনি বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে তার সারটুকু , অর্থাৎ সদর্থক অংশটুকু পান করে , 'অসার ' অংশটুকু বর্জন করতে হবে।  -  মোদ্দা কথা , না পরে "সব ঝুট হ্যায় " বলাটা কোনো মতেই মার্ক্সীয় পথ নয়। স্বয়ং মার্ক সাহেবকেও তাহলে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে হত না।  'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ' বইতে বিবেকানন্দ তো বলেইছেন , " ইলিশমাছ রইলো গঙ্গায় আর তুই ঘরে বসে ইলিশমাছ  ত্যাগ করলি , তো তাতে মাছের-ই  বা কি এসে গেল ,তোরই বা কি এলো গেল  ! আগে মাছ খা  , তার স্বাদ জান , তারপর ত্যাগ কর ; তখন বুঝব। " অর্থাৎ  খন্ডিত জ্ঞান নিয়ে শুধু সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নই দেখা যায় , যথার্থ পরিবারতন আনা যায় না ।   মার্কস থেকে  মাও সে তুং পর্যন্ত সব প্রবক্তারাই তাঁদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাতেও প্রচুর পড়াশুনা করেছেন।

দুই তত্তের দড়ি টানাটানিতে আমাদের প্রায় ধস্ত-বিধস্ত অবস্থা।  এবং স্বাভাবিকভাবে আমার মতো আরও অনেকেই সহজ রাস্তাটাই বেছে নিল। 

দেখতে দেখতে অ্যানুয়াল পরীক্ষা এসে পড়ল।  ভালো রেজাল্ট করার ছিটেফোঁটা মোহ -ও তখন আর বিদ্যমান নেই।  পরীক্ষার হলে বসে শুধু মাত্র পাসমার্কসটুকুর উত্তর লিখে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে আসতাম।  ফলে যা হবার তাই হলো  কিন্তু সে কথা পরে হবে।  তার আগের কিছু ইতিবৃত্ত আছে।  সেটি না বললে সম্যক বিষয়টি বোঝা যাবে না। 

তখন হেডমাস্টারমশাই অমুল্যজীবন ভট্টাচার্য।  তাঁর নেতৃত্বে প্রতি বছর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো ঘটা করে।  সে বছর নাটক হবে - অখিল নিয়োগীর 'আত্মহত্যা। ' একটি ফেল করা ছেলের মজাদার কাহিনী।  ছেলেটির নাম 'বিমান। ' যে চরিত্রটির অভিনেতা আবার এই অধম।  অভিনয় ছাড়া যথারীতি আবৃত্তি তো আছেই। 

আমার বাছাইএর মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের 'আফ্রিকা' কবিতাটিও।  কেন জানি , উনি বার বার ঐ কবিতাটি আমার মুখে শুনতে চাইতেন।  রিহার্সালে প্রায় দু তিন বার তো বলতে হতোই।  একদিন জিজ্ঞেস করলাম , "স্যার , আফ্রিকার মধ্যে এমন কী আছে - যে বার বার শুনেও আপনার আশ মেটে  না ! "  বললেন , "তোর্ ঐ 'উদ্ভ্রান্ত ' শব্দটা উচ্চারণের মধ্যেই আমি একটা দিশেহারা সময়ের উথাল পাঠাল ছবি সপষ্ট দেখতে পাই। " আমার আবৃত্তি নিয়ে অনেকের অনেক প্রশংসা শুনেছি।  কিন্তু জীবনের ঊশা লগ্নের এই কটি কথা আজ-ও  সোনার আখরে বুকের মধ্যে গাঁথা  হয়ে আছে।

সে যাই হোক , রেজাল্ট বেরোবার দিন এগিয়ে আসছে।  আমাদের রিহার্সালও প্রায় শেষের দিকে।  পরীক্ষার পর পরই  শুরু হয়েছিল , প্রায় এক মাসের টানা রিহার্সাল। পার্ট মুখস্ত , মিউজিক  রিহার্সালও নিয়মিত চলছে।  এহেন সময়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত রেজাল্টের দিন ঘোষণা হলো।

রেজাল্টের দিন প্রথা -অনুযায়ী হেডমাস্টারমশাই এসে রোল ধরে ধরে পাশ করা ছেলেদের নাম ডাকেন।  যাদের নাম বাদ পড়ল বুঝতে হবে তারা 'ফেলু। ' অন্যবার আমার নাম ঘোষণা হলেই কিস্কিন্ধাপতির নেত্য শুরু করে দিই।  কিন্তু এবার। ... অবাক কান্ড !
-তিরিশ - সন্দীপ দত্ত -
-ইয়েস স্যার ! সন্দীপ গিয়ে হেডমাস্টারের হাত থেকে রেজাল্ট সীটটা নিয়ে এলো। 
-একত্রিশ।  নৃত্যকালী ঘোষ  -
-ইয়েস স্যার !
-পৈত্রিশ ! অনন্ত ভৌমিক -

একী ! আমার রোল নম্বর কোথায় গেল !তেত্রিশ ! কে যেন পাহাড়ের ওপর থেকে এক ঠেলা মেরে আমায় গভীর খাদের মধ্যে ফেলে দিলো।  দু চোখে অন্ধকার  ....... কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো  ....... বুকে লক্ষ হাতুড়ির শব্দ। .. কতক্ষণ এরকম ছিলাম জানি না - হঠাৎ মনে হলো , আমার দু চোখের কোল বেয়ে উষ্ণ প্স্রবন নেমে আসছে।  ভিষণ লজ্জা পেলাম।  এ বাবা , চোদ্দ বছরের একটা ছেলে সবার সামনে  ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে ! তাড়াতাড়ি  হাত দিয়ে মুছতে গিয়ে দেখলাম , উরিব্বাস ! সেখানে জলের লাইন পরে গিয়েছে , হাতের আড়াল ঠেলে তারা হুড়োহুড়ি  করে বেরিয়ে আসতে লাগলো।  আমি তাড়াতাড়ি বেঞ্চির উপর মুখ রেখে দু হাতের কান্ডার করে লজ্জা নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলাম।  ব্যর্থ ; এবং কারো - কারো কাছে হয়তো হাস্যকরও। 

বাস্তবিক , সেই মুহুর্তের আগে বুঝতেই পারি নি যে 'পরীক্ষা ' নামক বাজে সিস্টেমটাকে আমি ভেতরে ভেতরে তখনো অত গুরুত্ব দিয়ে চলেছি। এ আঘাত আমার জীবন জুড়ে এক গভীর খাত সৃষ্টি করলো।  জীবনের ঊষাকালের নরম মনটাকে কে যেন কশাঘাতে - কশাঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দগদগে  ঘা করে তুলল।  যে আমি  ভাবলোকের শরত আকাশে পরমানন্দে মেঘ সাঁতরে বেড়াচ্ছিলাম , কে যেন সেই উত্তুঙ্গ উচ্চতা থেকে সশব্দে  রুক্ষ মাটির উপর আছাড় মারলো। বাস্তবিক , ছাত্র জীবনে ফেল করা যে কী নিদারুন প্রাণান্তকর যন্ত্রণা , যে না করেছে তাকে বোঝানো যাবে না। 

হেডমাস্টারের সঙ্গে ক্লাসটিচার হিসেবে প্রতাপবাবুও ছিলেন।  তিনি সম্ভবত প্রিয় ছাত্রের এই মর্মান্তিক যন্ত্রণা লক্ষ করেছিলেন।  ভিতরে ভিতরে তাঁর অন্তরটাও কী দীর্ণ বিদীর্ণ হয় নি ! কে জানে। ..! .... অবশ্যই হয়েছিল।  তাঁর মত  অপরের যন্ত্রণা  দেখে দেখে কখনই স্থির   পারে না।  কিন্তু সেই মুহুর্তে তাঁর-ই বা কী করার ছিল ! আমার মত তিনিও তো তখন সিস্টেমের হাতে অসহায়।



 


সত্তর দশকের এক ব্যাচেলর'স রুম। .. 44 গ্রে স্ট্রীট


( পরবর্তী পর্ব আগামী শুক্রবার )

Saturday, November 1, 2014

 
 
 
এই অলস দুপুর 
তোমার ভিতর আমি 
আমার ভিতর তুমি 
আমার মুখে নরম রোদের আলো 
তোমার ক্যামেরা 
পিছনে দূরদৃষ্টির আলো , না ঝলকানো। 
 
তুমি আর আমি 
কত গলা জড়াজড়ি 
কত আদর , সোহাগ , ভালবাসা 
কত রাগ , কত ঝংকার 
কত শত না বলা ভাষা। 
 
 
আমার চারিদিকে তুমি 
কঠিন দিনের দৃঢ়তা তুমি
সৎ পথের দিশা তুমি
নরম মনের পরশ তুমি
আলতো হাতের আদর তুমি
অনেক -
অনেক মনে পড়়া তুমি। 
 
 
তুমি আমার রাত্রি জাগরণ 
আতঙ্কেতে ছটফটানো মন 
বুকের মধ্যে জাপটে থাকা 
আমরণ আঁকড়ে থাকা 
আমার পরম প্রিয় জন। 
 
 
তুমিই আমার ঘুম ভাঙ্গানোর গান 
গভীর ঘুমে কানে আসা 
শুক সারীর ওই টান। 
তুমিই আমার মধ্য দিনের 
তেতে ওঠার ঘ্রাণ 
আমার উঁচু মাথা , আমার আত্ম অভিমান। 
 
 
আমার শিক্ষা , আমার রুচি 
আমার মিলেমিশে থাকা 
আমার সব কিছুতেই বড্ড তুমি 
 মস্ত বড় ফাঁকা নিয়ে 
আমার নিত্য বেঁচে থাকা। 
 
 
সহজ - সরল সত্য তুমি
হয়ত ,
হেরে যাওয়া এক পথিক তুমি 
তবুও বড্ড আমার তুমি 
আমার শরীর জুড়ে , মনকে মুড়ে 
তোমারই ছায়া 
পলকে পলকে খুঁজতে থাকা 
একটি কায়া। 
 
 
আমার চোখে লাগিয়েছিলে 
প্রকৃতিপ্রেমের ঘোর 
আজও ঘোরে বিভোর আমি 
তোমার চোখেই বিশ্ব দেখি
অশুদ্ধিতেও শুদ্ধি দেখি 
আজ কি তবে এমনি করেই কাছে আসো ?
আজও কি তুমি এই মাটিকে 
অমনি করেই ভালোবাসো ?
এসো , আমার কাছে এসো  
এটুক শুধু বলার আমার 
" বিকেল হলো , বাড়ি এসো ।"
 
 
 
 

Tuesday, October 28, 2014

 

আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে 

 
 
 
                               অঝোর ঝরে বাদল ঝরে যায়                                 আকুল করা উদাস সমীরণে
   
                          মন বাউলের দুকুল ভেসে যায়                               হারিয়ে যাওয়ার একলা কোনো ক্ষণে ।    

                                                           শ্রাবণ আমায় মাতাল করে ।   
               

                        এগোয় না আজ কালো মেঘের বেলা                         শরীর জুড়ে নেশার আবিল তোলে


                          কালোয়   সাদায় তড়িৎ  এলা খেলা                         টুপটাপ তান জমতে থাকা জলে
                                    
                                                             শ্রাবণ আমায় পাগল করে ।                                  
 
 
 

Friday, October 24, 2014


আমার কালীপুজো 

এক স্মৃতিচারণা 

  

 

কালীপুজো  মানেই বাবা। একটা ঠান্ডা নামা গন্ধ।  বেলা ছোট হয়ে আসা বিকেলে ট্রেনের আওয়াজ।  একটা ছোট্ট স্টেশনে অল্প থামা প্যাসেন্জার ট্রেনের সরু দরজা দিয়ে তাড়াহুড়ো  করে লাফিয়ে নামা আর ট্রেনের শেষ কামরাটা মিলিয়ে যাওয়া অবধি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা। গুটি কয়েক দাঁড়ানো রিক্সা নিয়ে রিক্সা স্ট্যান্ড। পরিচিত বুড়ো কোনো মুখ।  রিক্সাওলা।  মদন , বুড়ো , বিশে। বাবা আর তাদের চোখের হাসিতেই বোঝা যায় - " নিজের দেশের লোক। " তারপর একটা একটা এক চালা , ভাঙ্গা চোরা অতি পুরনো মিষ্টির দোকান। ভন ভন করে মাছি উড়ছে সব কটা মিষ্টির থালার উপর। পৃথিবীর সব চেয়ে সুস্বাদু রসগোল্লা।

তারপর।  তারপর আহ।  আমার গ্রাম।  মসৃন রাস্তায় ধীর গতিতে আরাম করে চলা রিক্সার ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ।  দু পাশে দু চোখ ভাসানো হেমন্তের ধানক্ষেত।  আর ঘুরতে থাকা প্যাডেলে রিক্সাওয়ালার পা। মনে এক অসম্ভব আনন্দ নিয়ে সবার সাথে চলেছি ছোট আমি। ঝুরি নামা বুড়ো বটতলাটা পেরিয়ে গেল।  বলফিল্ড , কার্লভার্ট , কার্লভার্ট এর উপর উবু হয়ে বসে থাকা বুড়ো দুটো লোক।  যেন অনন্তকাল ধরে ওরা ওখানেই বসে আছে।  যেন প্রতিবারই আমার দিকে এমন ভাবেই তাকিয়ে থাকে ওরা আর নীরবে জিজ্ঞেস করে , " কারা যায় ? " ডান ধারে একটা চালা ঘর।  রাশি রাশি লম্বা পাটকাঠি শুকোয়।  প্রতিবার বাড়ির সামনে দুটো বাচ্চা খেলা করে আর তাদের রোগাটে বুড়ি ঠাকমা , পথের উপর বসে রাস্তা দেখে।  আর একটু এগোলে বাঁ দিকে একটা বড় উঠোনওয়ালা বাড়ি।  কুঁড়েঘর।  উঠোনে দুটো পেল্লাই ধানের গোলা আর পাশে বসে জাবর কাটতে থাকা দুটো গরু।  একটা সাদা , একটা কালো।  বাবা একবার নেমে গিয়ে ছবি তুলেছিল।  কোথায় সেই ছবিটা ? কে জানে !

বকুলতলার মোড় ঘুরতেই আমাদের পাড়া।  চেনা ঘর, চেনা দোকান , চেনা পোস্টাপিসের  লাল বারান্দা।  ডাইনে  বাঁ এ বড় বড় ঠাকুরদালান আর সেখানে কাঠামোয় মাটির প্রলেপে সেজে উঠতে থাকা কালীর মূর্তি।  রিক্সাটা  পোস্ট অফিস থেকে বাঁ দিকের ঢালে নামতেই ভিতরে ছটফটানি উত্তেজনা।  ডান দিকে ঘুরতেই ঠিক একই জায়গায় ভেঁপু হর্ন বাজায় রিক্সাটা।  বহু পুরনো লোক।  জানে ঠিক , দোতলার জানলায়  বহুক্ষণ ধরে উত্কীর্ণ হয়ে বসে আছে একজন , আমার ঠাম্মা।  সারা বছর বসে থাকে সে ওই একটা হর্নের অপেক্ষায় , মস্ত এক বাড়িতে , একা।

রিক্সাকে  বলতে হয় না।  ঠিক দরজার সামনেই দাঁড় করায় সে।  আহ আমার বাড়ি।   দরজায় ঠাম্মা।  তাই কালীপূজো মানেই অপেক্ষা।  ঠাম্মার অপেক্ষা আমাদের জন্য।  আমার অপেক্ষা গ্রামের জন্য , বড্ড প্রিয় বাড়িটার  জন্য , কালীপুজোর জন্য।  আমার অপেক্ষা আজও  থেকে গেছে।  কিন্তু আমার অপেক্ষায় আর কেউ নেই।  আজও অভ্যেসবশত প্রতিবার কালো জানলাটার দিকে তাকাই।  বন্ধ জানলা।  আজ কেউ গরাদ ধরে বসে থাকে না।

#
 
আমার অখ্যাত গ্রাম , বেলপুকুর।  ইতিহাসের দিক থেকে অতি প্রাচীন , নদিয়ার এক গ্রাম। কেউ চেনে না।  কেউ নাম ও জানে না।  জানি শুধু আমি।  ছোট্ট একটা নিজের মনে থাকা মেয়ে।  তার চেনা গন্ডির মধ্যে প্রতিদিন আবিস্কার করে সে বিস্মিত হওয়ার  নতুন নতুন উপাদান , ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নতুন কোনো গিরগিটি , হ্ঠাৎ লাফিয়ে ওঠা কোনো ছানা ব্যাং অথবা বন বাদরের মধ্যে অবহেলায় গজিয়ে ওঠা নতুন কোনো জংলি ফুল।  পাশেই শীতে শুকিয়ে যাওয়া অগভীর খাল।  জলের  কাছে যেতে হলে অনেকটা শুকনো খেত পেরোতে হয়।  আবাল্য শহরে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে আল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে অনায়াসে গিযে পৌছোত জলের ধারে।  দু হাতে জড়ো করত কচুরিপানার ফুল।  সারাদিন ছোট্ট  একটা মাটির ঘটে ভেজানো থাকত ফুলের সেই গোছা। আজ যদি পেতাম , রজনীগন্ধার বদলে কচুরিপানার ফুলেই ঘর সাজাতাম আমি।  অপূর্ব সে ফুল।  আমার সব চেয়ে প্রিয় ফুল , কচুরিপানা । 
 
 
বেলপুকুরে প্রতি ঘরে ঘরে কালীপুজো হয় , অতি প্রাচীন কাল থেকে।  শুনেছি এখানেই প্রথম কালীপুজোর পত্তন হয়। পঞ্চমুন্ডির আসনে।  সত্য মিথ্যা জানি না।  তবে মানি।  শুনে আসা প্রতিটা কথাকে বিশ্বাস করি।  ভালো লাগে বিশ্বাস করতে। 
 
সেই থেকেই পুরো গ্রাম শাক্ত।  বাংলার বোধ হয় এক মাত্র জায়গা , যেখানে দুর্গাপুজো নয় , কালীপুজোই মূল উৎসব।  ঘরে ঘরে কালীর আরাধনা।  বাড়িতেই ঠাকুর গড়া হত তখন ।  অনেক পরে বড় হয়ে জেনেছি , ওটা আমাদের নয় , লাগোয়া জ্ঞাতির বাড়ির পুজো।  আইন যাই বলুক , আমার শিশু মন তাকেই বাড়ির পুজো বলে জানত, আজও  জানে।  বাড়িতেই ঠাকুর গড়া হত তখন।  সুবোধ , আমাদের বাড়ির কুমোর , নিরীহ , রোগা , গোবেচারা ভাবের একটা লোক ,  সারাবছর আমার জন্য মাটির পুতুল বানিয়ে দিত।  কত পুরনো মানুষের নাম - মুখ মনে পরে যাচ্ছে আজ লিখতে বসে।  সেই সুবোধ সারাদিন ধরে  ঠাকুর বানিয়ে যেত এক মনে ।  আমি আর দাদা দুজনেই বার বার দেখতে যেতাম ছুটে ছুটে , কত দূর হলো ।  আর শুধু জিজ্ঞেস করতাম ,  " চোখ কখন আঁকবে ? আমাকে ডেকো  কিন্তু।  " বলা বাহুল্য সুবোধ কোনো দিনই ডাকে নি।  তবে   কোনো দিন আমাকে ফাঁকিও দিতে পারে নি। ।  চোখ আঁকার সময় ঠিক পৌছে যেতাম আমি  সামনে। কালো মুখে লাল টানা চোখ - একটানে এঁকে যেত ও। প্রতিবার এক রকম।  কোনো বার এত টুকুও অন্য রকম হয় নি।  আমি মা এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতাম , নিস্পলক , নির্বাক ।  আজ সুবোধ নেই।  এখনো একই রকম মাতৃমূর্তি হয়।  কালো মুখে টানা টানা লাল চোখ।  হাত বদলেছে , কিন্তু ঘরানা বদলায়  নি।  কোথাও এতটুকু অন্যরকম হয় নি। 
 
 
#
 
 
কালীপুজোর আগের দিন।  ঠাকুর  পাটে ওঠার দিন।  চোদ্দ শাক , চোদ্দ প্রদীপের দিন।  আমার কচি হাতে ঘন্টার পর ঘন্টা আলপনা এঁকে যাওয়ার দিন।  তখন কেনার প্রথা ছিল না।  আমি ই এদিক ওদিক ঘুরে চোদ্দ রকম শাক তুলে আনতাম।  আমি , দাদা , ঠাম্মা - তিন জনে মিলে সাত দিন আগে থেকে বানাতাম মাটির প্রদীপ।  অত বড় বাড়িতে চোদ্দটা  প্রদীপ খুজেই পাওয়া যেত না।  কিন্তু চোদ্দটাই জ্বালানো হত সেদিন।  পরের দিন সাজানো হত বেশি প্রদীপ দিয়ে।  আজ বাড়িতে বাড়িতে রকমারি চীনা আলো।  টিমটিমে প্রদীপ শিখাগুলো জিততে পারল না তাদের কাছে। 
 
 
বিকেল থেকে সাজতে শুরু করত ঠাকুর।  একটা একটা করে ডাকের সাজ উঠত আর একটু একটু করে মোহময়ী হয়ে উঠত সদানন্দময়ী কালী , মহাকালের মনমোহিনী।  আমি তখন ও আলপনা দিয়ে  যেতাম, যতটা পারা যায়। খালের ধার থেকে পর পর ঠাকুর পাটে তোলা হত মহাসমারোহে।  সেটাই রীতি।  সেই কস্মিনকাল থেকে কোনো রীতির বদল ঘটায় নি বেলপুকুর।  আজও ঘটায় না।  একই  রকম  নির্ঘন্ট মেনে , প্রথা মেনে ঠাকুর পাটে ওঠে ঘরে ঘরে।  একই রকম প্রথা মেনে বিসর্জনে যায় , একসাথে। 
 
#
 
কালীপুজোর দিন ভোর বেলা।  শিশির ভেজা ঠান্ডা।  ভোর চারটেয়  উঠতাম আলো ফোটার আগে।  আলো ফুটলেই গাছে আর কোনো ফুল পাওয়া যাবে না ।  আমি আর ফুলি , ছোট্ট  দুটো মেয়ে , কুয়াশা মাখা ভোরে ঠিক বেরিয়ে পড়তাম।  ফুল চুরি ই বলে একে , না ? এখন কাউকে অত কাকভোরে উঠতে হয় না ।  এখন বস্তা বস্তা ফুল কিনে আনা হয় , কৃষ্ণনগর থেকে।  সারাদিন কি ব্যস্ত ভাব আমার তখন ! যেন আমি না থাকলে কাজগুলো আর করবে কে ? বড়রাও বলত , " ভাগ্যিস তুই ছিলি ,নইলে এই কাজগুলো করত কে ? " এখন ভাবলে হাসি পায়।  ছোট্ট মেয়েটাকে অসীম গুরুত্বের  প্রশ্রয় দেওয়া  বয়স্ক মানুষগুলো আর নেই।  মেয়েটাও আর ছোট নেই। 
 
 
কালীপুজোর রাত।  বাড়িটাকে আলোয় আলোয় সাজানো হত।  এখন মনে হয় সত্যি কি সাজাতে পারতাম বাড়িটাকে ? ঐটুকু মোমবাতির আলো কত টুকুই বা ভরাতে পারত অত বড় বাড়িটার ? কিন্তু ভরে উঠতাম আমরা।  অমাবস্যার মিসকালো অন্ধকারে ছাদের পাঁচিলে জ্বলতে থাকা মোমবাতি গুলো দূর থেকে জানিয়ে দিত , ওটা আমার বাড়ি। 
 
 
আমাদের খুব ছোটবেলায় ইলেকট্রিসিটি ছিল না গ্রামে।  আমাদের ঠাকুরদালানটা  প্রাচীন। সংস্কার হয় নি তখনও।  ভেঙ্গে পড়া দেয়াল , ইঁট বের করা শ্যওলা ওঠা থাম।  নিশুত রাত , পুজো হচ্ছে।  দুধারে দুটো মশালের মত আগুন জ্বেলে।  সেই মশালের গনগনে আলোয় , কালো কালী মা। রক্তচক্ষু।  তার রক্তমাখা চরণতলে বসে খোকন কাকার উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারণ।  মাঝরাতে বলির ভযে ঘরে সিঁটিয়ে বসে থাকা আমি , আর বলির হাঁড়িকাঠ ঘিরে সম্মিলিত  পুরুষকন্ঠের " মা , মা " রব।  এই আমার কালীপুজো।  পুজোর সময় , আরতির সময় , বলির পরে পরতে পরতে বদলে যাওয়া মা এর মুখ , চাহনি , হাসি।  এই আমার কালীপুজো। 
 
 
#
 
 
জানি না আমার প্রজন্মের আর কজনের ভাগ্য হয়েছে এমন কালীপূজো দেখার।  আজকের  লেখা সেই সমস্ত পুরনো মানুষকে মনে করে , যারা আমার শৈশবে এমন দুর্লভ স্বাদাস্বাদ্ন করিয়েছেন আমায়।  ঠাম্মা , বাবা , গনেশ জ্যেঠু - সবাই।  গনেশ জ্যেঠু , যার ঠক ঠক ঠক ঠক লাঠির আওয়াজ আয়োজনের প্রত্যেকটা কোণকে ভরিয়ে রাখত আন্তরিকতায় , আপ্যায়নে , অভ্যর্থনায়।  কোথায় সেই বুড়ো মানুষটা ? আজ তাকে বড্ড দরকার।  বড্ড ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে আজ সবকিছু।  আমাদের প্রজন্ম পারে নি এত বছরেও ওই একটা মানুষের ছোঁয়াকে পরিপূরণ করতে।  আজ ও জায়গাটা  ফাঁকা। 
 
 
#
 
 
কালীপুজো মানে শুধু ছোটবেলা নয়।  কালীপুজো মানে বড়বেলাও।  কালীপুজো মানে বাবার  অচেতন , কাত হয়ে যাওয়া মুখটা নিয়ে পাগলের মত ডাকতে থাকা।  কালীপুজো মানে নিবে আসা আলোর শিখাটাকে অবুঝের মত জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করা।  কালীপূজো  মানে অন্ধকার রাস্তায় বাড়ি বাড়ি ছুটে বেড়ানো একটা স্তেথস্কোপের জন্য।  কালীপূজো  মানে বাবা আর বাবার মা কালী। আমার মা কালী।  বড় কাছের , বড় নিজের।  রক্তের মধ্যে মিশে যাওয়া একটা নাম , মা কালী।  একমাত্র অবিচল বিশ্বাসের  একটা নাম , মা কালী। 
 
 
তারপর থেকে আর কোনদিন কালীপূজো প্রজ্বলিত হয় নি আমার মনে।  এখনো তবু প্রদীপ জ্বালাই।  আনন্দ করি বা করার চেষ্টা করি।  " ত্স্মাচ্ছ্কং পরিত্যজ্য শ্রেয়সে প্রযতেদ বুধঃ। " মৃত্যু দেখে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।  সামনে যা করণীয় আছে , তা করে যেতে হবে।  তাই করে যাই।  থামি না।  তবু যেন জীবন থেমে যায় - এই একটা দিনের জন্য। 



 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

এলবামের পাতা থেকে উঠে আসা কিছু পুরনো ছবি